সংশোধিত পাঠ্যবই নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ৯:৪৩:০০ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংশোধিত পাঠ্যবই নিয়ে একের পর এক আলোচনা চলছে, চলছে বিতর্কও। এরমধ্যে ‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে বিতর্ক সংঘর্ষেও রূপ নিয়েছে।প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে চলতি শিক্ষাবর্ষে। বইয়ে কোথাও তথ্য ভুল, কোথাও আবার তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্কও।
গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন পাঠ্যবইয়ে গত জুলাই-অগাস্টের ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন নিয়ে নানা ইতিহাস যুক্ত করা হয়েছে। কোনো কোনো বইয়ে এই অভ্যুত্থানের ইতিহাস অংশে আওয়ামী লীগ কিংবা শেখ হাসিনার নাম বাদ দেয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। আবার আন্দোলনে নিহতদের নাম নিয়েও ভুল ধরা পড়েছে। কয়েকটি পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর কিছু কিছু বইয়ে সংশোধনীও আনা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিমার্জন করতে কিছু কিছু পরিবর্তন এমনভাবে করা হয়েছে যেটি নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেছেন, এবার ভুলের পরিমাণ কম, কিন্তু বিতর্ক বেশি। বিতর্ক মানে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বা দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা। এখন এটা কি আপনারা টলারেন্স দিয়ে মোকাবিলা করবেন নাকি এটাকে সংঘাত দিয়ে মোকাবিলা করবেন, সেটিই হচ্ছে মূল বিষয়।
গণঅভ্যুত্থানের গল্প ও প্রবন্ধ নিয়ে প্রশ্ন :
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া ও ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে নতুন পাঠ্যবইয়ে। পঞ্চম শ্রেণি থেকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে মোট আটটি কনটেন্ট বা বিষয় স্থান পেয়েছে। এছাড়া বইয়ের পেছনের পৃষ্ঠায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নানা ছবি ও গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে।
নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলা সাহিত্য’ বইয়ে ‘আমাদের নতুন গৌরবগাঁথা’ অধ্যায়ে লেখা হয়েছে “আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা এক দফা দাবি পেশ করেছে। সারা দেশ থেকে মানুষ ঢাকায় ছুটছে। ঘেরাও করবে গণভবন। মূলোৎপাটন করবে শাসন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা ফ্যাসিবাদী এক শাসককে। নিপীড়ক সরকারও প্রস্তুত। তার আছে দলীয় বাহিনী, আছে সরকারি নানা বাহিনীকে অন্যভাবে ব্যবহারের নিত্যদিনের অভ্যাস।
৫ আগস্ট ঢাকার রাস্তার অবস্থাও উঠে আসে এই প্রবন্ধের বর্ণনায়। সেখানে লেখা হয়-পতন অত্যাসন্ন টের পেয়ে স্বৈরাচারী সরকারপ্রধান পালিয়ে যান দেশ ছেড়ে। অভাবনীয় এক গণঅভ্যুত্থান দেখে সারা দুনিয়ার মানুষ।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে নবম-দশম শ্রেণির এই প্রবন্ধে কোথাও স্বৈরশাসক হিসেবে ‘শেখ হাসিনা’ কিংবা তার দল ‘আওয়ামী লীগে’র নাম লেখা হয়নি।
পরিমার্জন কমিটির দায়িত্বে থাকা সাজ্জাদুর রহমান, যিনি রাখাল রাহা নামেও পরিচিত, তিনি এর একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরে বলেছেন, নাইনের বইয়ে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের নাম না থাকলেও অষ্টম শ্রেণির বইয়ে দুটি নামই আছে। শেখ হাসিনা বিনা ভোটে জিতেছেন, গুম খুন করেছেন – সে সবই অষ্টম শ্রেণির বইয়ে আছে। বিচ্ছিন্নভাবে একটা টেক্সট দিয়ে সব পাঠ্যবইয়ের যদি মূল্যায়ন করতে চান, তাহলে তো মানদ- ঠিক হয় না।
সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ে জুলাই-অগাস্টের আন্দোলন নিয়ে হাসান রোবায়েত নামে একজন কবির একটি কবিতা ছাপা হয়েছে।’সিঁথি’ শিরোনামে ছাপা কবিতার শব্দ চয়ন নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।”ভাই মরল রংপুরে সেই/ রংপুরই তো বাংলাদেশ’ নুসরাতের আগুন দিল, দোজখ যেন ছড়ায় কেশ।কওমি তরুণ দাঁড়ায়া ছিল, কারবালারই ফোরাতে, শাহাদাতের আগুন দিয়া, খুনির আরশ পোড়াতে”।
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাত বই পৌঁছানোর পর এই কবিতার শব্দ চয়ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্যও করতে দেখা গেছে। মো. মাসুদ নামে একজন ফেসবুকে পোস্টে লিখেছেন, এই কবিতার মাঝে ভাষা বানান মাত্রা ছন্দ সবকিছুর মাঝে ত্রুটিবিচ্যুতি আছে। কবিতাটি স্বজন প্রীতির কারণে পাঠ্য বইয়ের মাঝে স্থান পেয়েছে! মানের কারণে এই কবিতাটি পাঠ্য বইয়ের মাঝে স্থান পায়নি!
এদিকে, নতুন পাঠ্যপুস্তকে কয়েকটি জায়গায় বিতর্ক ওঠার পর কিছু কিছু জায়গায় এরইমধ্যে অনলাইন বইয়ে সংশোধন এনেছে এনসিটিবি।জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাহিত্য নিয়ে যেসব বিষয়ে প্রশ্ন আছে সেব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানায় এনসিটিবি।
ভুল ও রাজনৈতিক বয়ান
নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়া নবম-দশম শ্রেণির ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বইয়ের ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন ব্যবস্থা’ শীর্ষক সপ্তম অধ্যায়ে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ অধ্যায়ে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ সাব টপিকে বলা আছে, “আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে পুরাতন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।এরপরই বিএনপির বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘সাবেক রাষ্ট্রপতির’ পরিবর্তে ‘সাবেক সেনাপ্রধান’ উল্লেখ করে তার শাসনামলকে সামরিক শাসনামল হিসেবে উল্লেখ করা হয়।গণঅভ্যুত্থানের পর পাঠ্যপুস্তকে বিএনপি সম্পর্কে এই বয়ান নিয়ে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।সেখানে এনসিটিবি’র সমালোচনা করেন তিনি। পরে পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সনে দ্রুত পরিবর্তন এনে নতুন করে তা সংশোধনও করা হয়।৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই পরিমার্জনের কাজ শুরু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।এজন্য ৪১ জন বিশেষজ্ঞ দিয়ে ৪৪১টি পাঠ্যবই পরিমার্জন করা হয়। এর মধ্যে কিছু বই শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হলেও অর্ধেকের বেশি বই এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া সম্ভব হয়নি।
বিতর্ক কেন পিছু ছাড়ছে না?
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের দেড় দশকে কয়েক দফায় পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়, বদল করা হয় কারিকুলামও। সর্বশেষ ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন বইয়ে প্রায় দেড়শো ভুল চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর আগের বছর ২০২৩ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ২২টি বইয়ে ৪২১টি ভুল পাওয়া যায়।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পরিবর্তনের পর নতুন সরকার পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিমার্জন করতে গিয়ে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বইয়ে জুলাই আন্দোলনের যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়, সেখানে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্র আবু সাইদের মৃত্যুর তারিখ ভুল হয়।
পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ নামে একটি গল্পের শেষে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের নামের তালিকায় আবু সাইদ, মুগ্ধ, নাফিজ, নাহিয়ান ও আনাস লেখা হয়।বইটি শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর পর জানা যায়, নাহিয়ান নামে জুলাই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে কেউ মারা যায়নি। এ নিয়ে সমালোচনা হওয়ার পর বইয়ে সংশোধন আনে এনসিটিবি।
সংশোধিত বই অনলাইনে যুক্ত করা হয়। তবে অনেক বই ছাপা হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে চলে যাওয়ায় সেগুলো সংশোধন করা যায়নি আর।
প্রাথমিক স্তরের বাংলা বইয়ের শুরুতেই আগে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা আঁকা নিয়ে তথ্য যুক্ত থাকতো। কিন্তু এ বছরের পাঠ্যবইয়ের একেবারেই শেষে তা যুক্ত হয়েছে।পরিমার্জন কমিটির দায়িত্বে থাকা সাজ্জাদুর রহমান বলেন, পরিমার্জন করতে গিয়ে আমরা দেখেছি ভুলের কোনো শেষ নেই। বেশ তাড়াহুড়ো করে আমাদেরও সংশোধনের কাজ করতে হয়েছে। এটি নিয়ে কখনও সংকট তৈরি হয়েছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে কিছু ভুল হয়।
কী বলছে এনসিটিবি?
বই সংশোধনের প্রসঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, পাঠ্যবইয়ে একাত্তরকে যেভাবে নষ্ট করা হয়েছে অতিরঞ্জন ও অতিকথনের মধ্যে দিয়ে, সেটা যেন জুলাই অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে না ঘটে সেটা ছিল আমার অবস্থান। পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন করতে গিয়ে আমরা এমন কোনো বাধ্যবাধকতা করিনি যে এটা দিতেই হবে বা অমুককে ঘৃণা করতে হবে। দেশের জন্য যার যতটুকু অবদান ততটুকুই আমরা বইতে দিতে চাই। আমরা কাউকে ঘৃণাও করতে চাই না, কাউকে প্রশংসায়ও ভাসাতে চাই না। আদিবাসী’ এই বিষয়টি কেন যুক্ত করা হলো, আবার কেনই বা তা বাদ দেয়া হলো এ নিয়ে প্রশ্ন করলে অধ্যাপক হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “যখন আমরা দেখলাম এটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, তখন বিতর্ক এড়ানোর জন্য এই বিষয়টিকে বাদ দিয়েছি।
এক্ষেত্রে ভালো-মন্দ বিচার করার বিষয় ছিল না। এটা নিয়ে যেহেতু বিতর্ক হয়েছে সে কারণে এটাকে আমাদের বাদ দিতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিতর্ক খারাপ কিছু নয়। যেসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক উঠেছে আমরা অনেক কিছুই সংশোধন করেছি। আমরা যদি একটা বহুবাচনীক রাষ্ট্র চাই, বহুত্ববাদী সমাজ চাই তাহলে আমাদের সহনশীলতার চর্চা করতে হবে।