স্থবির রেলপথ, সীমাহীন ভোগান্তি
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৮:৩৬:৩৬ অপরাহ্ন
# কর্মবিরতিতে অনড় রানিং স্টাফরা
# আলোচনার দরজা খোলা : রেলপথ উপদেষ্টা
স্টাফ রিপোর্টার : রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। সোমবার মধ্যরাতের পর থেকেই সিলেটসহ বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে চরম অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে রেল বিভাগে। সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা।
স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় অনেক যাত্রীকে বসে থাকতে দেখা গেছে। তাঁদের অনেকেই ট্রেন চলাচল বন্ধের খবর জানতেন না। সকাল থেকেই সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। সকাল সোয়া ৯টার দিকে সিলেট স্টেশনে অনেক যাত্রীকেই ট্রেনের খবর জানতে আসতে দেখা যায়। ট্রেন চলবে না জেনে অনেকেই স্টেশন ছেড়ে চলে যান। তবে বয়স্ক ও নারীরা অনিশ্চয়তা নিয়ে স্টেশনেই অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। তবে স্টেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পরিস্থিতি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু করা সম্ভব নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে সিলেট থেকে ঢাকাগামী কালনি এক্সপ্রেস নির্ধারিত সময়ে যাত্রা শুরু করতে পারেনি। এতে বিপাকে পড়েন সিলেটের হাজারখানেক যাত্রী। সিলেটের অন্যান্য স্টেশনেও ট্রেনের অপেক্ষায় যাত্রীদের বসে থাকার খবর জানা গেছে। অনেকে বিকল্প পথে যাত্রা শুরু করেন।
এ বিষয়ে রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক নুরুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে আমরা টিকিটের টাকা ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয়ভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে সকাল থেকে সিলেট রেল স্টেশন হতে কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি।
প্রতিদিন সিলেট থেকে চট্টগ্রাম ও ঢাকাগামী মোট ছয়টি ট্রেন চলাচল করে। তবে কর্মবিরতির কারণে এসব ট্রেনের চলাচল বন্ধ রয়েছে। কোনো সমাধান না হলে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সিলেট রেলওয়ে স্টেশন অপেক্ষমান যাত্রীরা অভিযোগ করেন- রেল কর্তৃপক্ষ অনলাইনে টিকিট যাত্রীদের যেভাবে রিফান্ড এপ্লিকেশন করতে বলেছে সেটা আরও ভোগান্তির। অনেক সময় ওয়েবসাইট কাজ করে না। অনেক চেষ্টার পর যখন রিফান্ড এপ্লিকেশন করতে পেরেছি তখন দেখা যাচ্ছে তিন কার্যদিবসের মধ্যে ফেরত দেওয়া হবে। অনেকেই দশদিন আগে টিকিট কিনেছেন। টাকা ফেরত পেতে যদি আরও তিন দিন তাহলে এই টাকা ফেরত পেয়ে লাভ কি। এছাড়া বিআরটিসির বাসের ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে। সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের সামনে যে বিআরটিসির বাস রাখা আছে তা শুধু দেখানোর জন্য। কোন যাত্রী পরিবহন করছে না তারা। এছাড়া লং জার্নির জন্য বাস অনেকেই চড়তে চান না।
সিলেটে আটকা পড়া অনেকেই বিআরটিসি বাসে যেতে চাচ্ছেন ঢাকায়। কিন্তু সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে দুপরে গিয়ে দেখা যায়, ‘সরকারি’ বাস কাউন্টারের সামনেবিআরটিসি বাসের প্যাসেঞ্জারে পূর্ণ না হওয়ায় ছেড়ে যাচ্ছে না। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আটকা পড়া ট্রেনযাত্রীরা।
সমাধান ছাড়াই বৈঠক থেকে বেরিয়ে গেলেন রানিং স্টাফরা :
কর্মবিরতির কারণে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনে আন্দোলনরত রেলের রানিং স্টাফ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে কোনো সমাধান ছাড়াই ওই বৈঠক থেকে বেরিয়ে গেছেন রানিং স্টাফ নেতারা।
রানিং স্টাফদের নিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে কমলাপুর রেলস্টেশনে বৈঠকে বসেছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সমন্বয়ক শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। কিন্তু বৈঠকে কোনো সমাধান না হওয়ায় রানিং স্টাফরা বেরিয়ে যান।
বেলা দেড়টার দিকে কমলাপুর স্টেশনের ভিআইপি কক্ষে এই বৈঠক শুরু হয়। বেলা ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই রানিং স্টাফদের প্রতিনিধি সাইদুর রহমান সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা দীর্ঘক্ষণ রেলসচিব, মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তবে কোনো সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাতে পারিনি বলে ওই বৈঠক চলাকালীনই আমি চলে আসছি। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যাঁরা আছেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করব। তবে আমরা আমাদের কর্মবিরতিতে অনড় আছি।
আলোচনার দরজা খোলা : যাত্রীদের জিম্মি করে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি কর্মসূচিকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেছেন, এতে সাধারণ মানুষই বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মঙ্গলবার সকালে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন ফাওজুল কবির খান।
উপদেষ্টা বলেন, স্টাফদের দাবির বিষয়ে আমাদের আলোচনার দরজা সব সময় খোলা আছে। প্রয়োজনে আমরা তাঁদের সঙ্গে আবার আলোচনা করব এবং অর্থ বিভাগেও তাঁদের এই দাবি নিয়ে আলোচনা করব।
ফাওজুল কবির খান বলেন, কোনো যাত্রী যদি স্টেশনে আসেন, তাঁদের সুবিধা বিবেচনা করে আমরা বিআরটিসি বাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছি, যাতে করে রেলের যে রুটগুলো আছে, সেখানে যাত্রীরা যেতে পারেন।
রানিং স্টাফদের দাবি কী : রানিং স্টাফরা হলেন, ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত পরিচালক (গার্ড), ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার), সহকারী চালক ও টিকিট পরিদর্শক (টিটিই)। এরা ট্রেন চালানোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ ধরনের কর্মী রয়েছেন প্রায় দুই হাজার। তাঁরা সাধারণত দীর্ঘসময় ট্রেনে দায়িত্বপালন করে থাকেন। ট্রেন চালক ও সহকারী চালকের সংখ্যা এক হাজারের কিছু বেশি। পরিচালক ও টিটিই মিলিয়ে রানিং স্টাফের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৯০০ জনের মতো।
দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে বেসিকের (মূল বেতন) হিসেবে বাড়তি অর্থ পেতেন তাঁরা। যাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় মাইলেজ। মাইলেজ রানিং স্টাফদের বেতনেরই অংশ মনে করা হয়। প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক দিনের বেসিকের সমপরিমাণ টাকা অতিরিক্ত পেতেন। ৮ ঘণ্টায় এক দিনের কর্মদিবস ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ দাঁড়ায় আড়াই বা তিন মাসের সমপরিমাণ।
এছাড়া অবসরের পর বেসিকের সঙ্গে এর ৭৫ শতাংশ অর্থ যোগ করে অবসরকালীন অর্থের হিসাব হতো। তবে ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর এই সুবিধা সীমিত করে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই সময়ের পর নতুন করে নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা পুরোনোদের চেয়ে আরও কম সুবিধা পাবেন বলেও সরকার সিদ্ধান্ত নেয়।
২০২২ সালের পর নিয়োগপত্রে দুটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা চলন্ত ট্রেনে দায়িত্বপালনের জন্য রানিং অ্যালাউন্স ছাড়া অন্য কোনো ভাতা পাবেন না এবং মাসিক রানিং অ্যালাউন্সের পরিমাণ মূল বেতনের চেয়ে বেশি হবে না। এ ছাড়া অবসরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বশেষ আহরিত মূল বেতনের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক পাবেন।