মাঘে উধাও বাঘ পালানো শীত
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:০৪:০৬ অপরাহ্ন
৯ বছর পর তীব্র শৈত্যপ্রবাহহীন জানুয়ারি
জালালাবাদ রিপোর্ট : এবারের জানুয়ারিতে ‘বাঘ পালানো মাঘের শীত’ দেখা গেল না। সিলেটসহ সারা দেশে শীত পড়েছে অন্যবারের চেয়ে কম। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবারের জানুয়ারি মাসে দেশে একটিও তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। যদিও প্রতিবছর অন্তত একটি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয় এ মাসে। তীব্র শৈত্যপ্রবাহহীন জানুয়ারি দেখা গিয়েছিল ৯ বছর আগে, ২০১৬ সালে। এবার জানুয়ারিতে গড় তাপমাত্রাও ছিল অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি, বিপরীতে কুয়াশা কম পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি, রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও অর্থনীতির ওপর শীত কম পড়ার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কম শীত মানে ডেঙ্গু আরও বিস্তারের সুযোগ তৈরি হওয়া; গম, আলু ও শর্ষের মতো ফসল উৎপাদনে ক্ষতি এবং শীতকেন্দ্রিক ব্যবসা কমে যাওয়া।
সবচেয়ে বড় দিক হলো, এভাবে শীত কমে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তনের ইঙ্গিত, যা নানা দিক দিয়ে সংকট তৈরি করতে পারে। টানা তিন দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে তা শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে গণ্য হয়। শৈত্যপ্রবাহের আবার চারটি ধরন আছে-মৃদু (সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ১ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), মাঝারি (৬ দশমিক ১ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস), তীব্র (৪ দশমিক ১ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও অতি তীব্র (৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে)। এবার জানুয়ারিতে দেশে শুধু একটি মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে। সেটি ছিল ১০ জানুয়ারিকেন্দ্রিক। ওই দিন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছিল।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, জানুয়ারি মাসের স্বাভাবিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বছরের জানুয়ারির গড় তাপমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৭।
এবারের জানুয়ারিতে দেশে কোনো তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়নি। দেশে ২০২৪ সালে ৪টি, ২০২৩ সালে ১টি এবং ২০২২ ও ২০২১ সালে ৩টি করে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হয়েছিল।শীত কম হওয়ার আরও তিনটি কারণের কথা বলছেন আবহাওয়াবিদেরা-এক. উচ্চ চাপ বলয় না থাকা। দুই. বজ্রমেঘ সৃষ্টি না হওয়া। এবং তিন. ইন্ডিয়ান ওশান ডাইপোলের (ওআইডি) নিরপেক্ষ অবস্থান।
এবার পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে বজ্রমেঘ কম সৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, বজ্রমেঘ বৃষ্টিপাত তৈরি করে। বৃষ্টি হলে শীতলতা বাড়ে। এবার তা-ও নেই। অন্যদিকে ইন্ডিয়ান ওশান ডাইপোলের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার একটি অনিয়মিত দোলন। এর তিনটি ধাপ আছে। সেগুলো হলো ইতিবাচক, নেতিবাচক ও নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষ থাকলে তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
শুধু জানুয়ারি নয়, আগের মাস ডিসেম্বরেও দেশের সার্বিক তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বেশি ছিল। ওই মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, এ মাসে দু-একটি মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ডিসেম্বরে মাত্র দুটি মৃদু এবং একটি মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ বলেন, এবার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মডেলে যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, তা মেলেনি। শীত অপেক্ষাকৃত কম পড়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ুর বেশ কিছু তৎপরতা এর কারণ।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় উষ্ণম-লীয় দেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া আছে। এর একটি দৃশ্যমান বিষয় হবে শীতের বিস্তৃতি বা পরিধি কমে যাওয়া। বাংলাদেশেও তাই ঘটছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে বাড়তে পারে।
আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, সাধারণত বছরের এ সময়ে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি থাকে না। এবার জানুয়ারি মাসজুড়ে বাতাসে জলীয় বাষ্পের আধিক্য ছিল। এ কারণে জানুয়ারি মাসে স্বাভাবিক শীত পড়েনি। তাঁর ব্যাখ্যা হলো, জলীয় বাষ্পের বিভিন্ন স্তরে সূর্যের তাপ সঞ্চিত থাকে। ফলে বায়ুম-লের উঁচু স্তর থেকে শীতল বায়ুপ্রবাহে বাধা তৈরি হয়।