বাড়ি বাড়ি না গিয়েই শেষ ভোটার হালনাগাদের ১ম ধাপ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২:৪১:১৩ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : বিতর্কের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের ১ম ধাপ। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারের তথ্য সংগ্রহের কাজ। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঘোষিত সময়নুযায়ী সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে না গিয়েই শেষ হয়েছে তথ্য সংগ্রহের কাজ। এ নিয়ে ক্ষোভ জাানিয়েছেন সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। তারা জানান, এবার হালনাগাদে ভোটার না হলে দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে পারেন নতুন ভোটাররা।
নগরীর বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, এবার যারা এখন পর্যন্ত ভোটার হয়েছেন প্রায় সবাই তথ্য সংগ্রহকারীদের কাছে স্বউদ্যোগে গিয়ে হয়েছেন। বাড়িতে আসবেন তথ্য সংগ্রহকারীরা এ কারণে যোগাযোগ করেননি বলেও জানান বাদ পড়াদের কেউ কেউ।
সিলেটের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অভিযোগ তথ্য সংগ্রহকারীগণ আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগকৃত। তারা বাড়ি বাড়ি না গিয়ে পতিত সরকারের দেখানো পথেই কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এতে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হলেও হালনাগাদ কার্যক্রম সঠিকভাবে হয়নি।
নগর এলাকায় সরেজমিনে খোঁজ নিয়েও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। নগরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, সিলেট নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি যাননি। কিছু এলাকায় তথ্য সংগ্রহকারীগণ বাড়ি বাড়ি না গিয়ে ক্লাব অফিস কিংবা একটি বাড়ীতে বসে আশপাশের মানুষের তথ্য সংগ্রহ করেছেন বলে অভিযোগ উঠছে। এছাড়া তথ্য সংগ্রহের কাজে জড়িত শিক্ষকসহ সরকারী বিভিন্ন পেশায় কর্মরত কর্মকর্তাগণ নিজের অফিস ডিউটি শেষে তথ্য সংগ্রহে বের হয়ে গিয়ে তেমন বাসা-বাড়ীতে যেতে পারেন নি। ফলে সীমিত বাসায় বসেই কাজ সেরেছেন। এমন চিত্র শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর কানিশাইল, লালাদিঘীরপাড়, সোবহানীঘাট, যতরপুর, সবুজবাগ, তেররতন, হাউজিং এস্টেট, খাসদবির, ভার্সিটি গেইট, টুকেরবাজার, বাদাঘাট, কুমারগাও, বালুচর, টিলাগড়, পীরের বাজার, পরগণা, শেখঘাট, শাহী ঈদগাহ, পাঠানটুলা, গুয়াবাড়ীসহ নগরীর বেশ কিছু এলাকায় তথ্য সংগ্রহকারীর দেখা পাননি অনেকেই। ফলে তারা ভোটার হতে পারেননি। এদিকে নগরীর শামীমাবাদ এলাকায় বাড়ী বাড়ী না গিয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে ক্লাব অফিসে বসে তথ্য সংগ্রহ করেন তথ্য সংগ্রহকারীরা। ফলে অনেকেই ক্লাব অফিসে গিয়ে ভোটার হতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
এদিকে একাধিক ভোটার তথ্য সংগ্রহকারীর সাথে আলাপকালে জানা গেছে, কিছু এলাকায় ব্যতিক্রম হতে পারে। তবে অধিকাংশ এলাকায় তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। তবে বাসা-বাড়ী এবং ফø্যাটে কেউ কেউ গেইট ও দরজা পর্যন্ত খুলেন নি। ফলে অনেককেই ফিরে আসতে হয়েছে। কয়েকজন তথ্য সংগ্রহকারীর অভিযোগ আমাদেরকে তথ্যসংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হলেও কর্মস্থল থেকে ছুটি দেয়া হয়নি। ফলে কর্মস্থলের কাজ শেষ করে আমাদেরকে মাঠে কাজ করতে হয়েছে। ফলে চাইলেও সব বাসা-বাড়ীতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে একটি বাসায় বসে আশপাশের কয়েকটি বাসার লোকজনকে সমবেত করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক একজন স্কুল শিক্ষক জানান, আমি একটি স্কুলে পড়াই। আমাকে সকালে উঠে স্কুলের ডিউটি করতে হয়। তারপর দুপুরে বাসায় গিয়ে খাওয়া ধাওয়া করে ফের তথ্য সংগ্রহের কাজে বের হতে হয়। ফলে চাইলেও খুব বেশী বাসা-বাড়ীতে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে রোববার ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা বিষয়গুলো দেখছি। দুশ্চিন্তা করার কারণ নেই। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করব, যাতে একজন ভোটারযোগ্য নাগরিক তালিকা থেকে বাদ না পড়েন।
নগরীর শামিমাবাদ এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, এখনও তার বাড়ি কিংবা এলাকায় ভোটার কাজে নিংযুক্ত তথ্য সংগ্রহকারী কেউ আসেননি। তবে মসজিদের মাইকে ঘোষণা শুনেছি ভোটার হতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাথে নিয়ে ক্লাব অফিসে যাওয়ার জন্য। এভাবে পরিচিত অনেকেই ভোট তুলতে যাননি বলে জানান তিনি।
উলেখ্য, ১৮ বছরে পর্দাপণ করা নাগরিকদের ভোটার করার উদ্যোগ নিয়ে গত ২০ জানুয়ারি থেকে আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্তÍ টানা ১৫ দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল কমিশন। সোমবার সেই তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হয়েছে। পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে তথ্য ফর্ম পূরণ করা নতুন নাগরিকদের ছবি তুলে ভোটার নিবন্ধন করার কাজ শুরু হবে আগামীকাল ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে। এ কর্মসূচি চলবে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। রোববার পর্যন্ত ১৯ লাখের মতো নতুন নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করেছে ইসি। কিন্তু বাড়ি বাড়ি না যাওয়ায় এখনও তালিকার বাইরে আছেন অনেক ভোটারযোগ্য নাগরিক।
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, তথ্য সংগ্রহ শুরুর তারিখ থেকে আমাদের কাছে অভিযোগ আসতে থাকে যে কেউ বাড়ী বাড়ী যাচ্ছেনা। এরপর বিষয়টি আমরা সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাকে অবহিত করি। পাশাপাশি আমাদের দলীয় নেতাকর্মীদেরকেও স্ব উদ্যোগে ভোটার হতে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য নির্দেশনা দেই। এরপর সম্মিলিত উদ্যোগের ফলে অনেকেই নতুন তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। এরপরও আমরা এ বিষয়ে উপজেলা ও পৌরসভা পর্যায়ে নির্দেশনা দিয়েছি। কেউ বাদ পড়েছে কিনা, হালনাগাদে কোন গাফিলতি হয়েছে কিনা। এরপর বিষয় নিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করবো।
এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, আজ সোমবার শেষ দিনে আমার বাসায় তথ্য সংগ্রহকারী দল এসেছেন। তাও অভিযোগের প্রেক্ষিতে। ফলে অন্য এলাকায় কি হয়েছে সেটা কিছুটা হলেও অনুমেয়। তথ্য সংগ্রহের ১৫দিন অতিবাহিত হলেও দৃশ্যমান কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
তিনি বলেন, অতীতে আমরা দেখেছি ভোটার হালনাগাদ চলাকালে একটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করতো। কাউন্সিলার ও সম্ভাব্য কাউন্সিলার প্রার্থীগণকে দেখেছি নিজেদের লোককে ভোটার তালিকাভুক্ত করতে দৌড়ঝাপ করেছেন। কিন্তু এবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেকটা নিরবে ও দায়সারাভাবে হালনাগাদ কার্যক্রম শেষ করেছেন। যা দুঃখজনক। স্ব স্ব এলাকার ব্যাপারে তথ্য না থাকায় তথ্য সংগ্রহকারী অনেকেই লোক চক্ষুর অন্তরালে কোনমতে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ বিষয়ে সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ১৫ দিনের ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম একেবারেই দায়সারাভাবে শেষ হয়েছে। এতে মৃত ব্যক্তিরা বাদ পড়েন নি, আবার নতুন অনেকেই ভোটার হতে পারেনি। তথ্য সংগ্রহকারীগণ বাড়ি বাড়ি না গিয়ে নির্দিষ্ট বাসা ও এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে আমাদের কাছে এমন তথ্য এসেছে।
তিনি বলেন, তথ্য সংগ্রহকারীগণ বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাই তারা ফ্যাসিস্টের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে কিনা বিষয়টি তদন্ত করে দেখা উচিত। একই সাথে তাদের নিয়োগ বাতিল করে নতুন তথ্য সংগ্রহকারী নিয়োগ দিয়ে ফের হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা নুরুল আলম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এমন কিছু অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা একাধিক তথ্য সংগ্রহকারী সুপারভাইজারদের ডেকেছি। তারা বলেছেন, অনেক বাসায় তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দারোয়ান বলে দিয়েছে এই বাসায় নতুন ভোটার হওয়ার মতো কেউ নেই। আবার কোন কোন বাসায় কেউ গেইট-দরজা খুলেনি। ফলে একাধিকবার ফিরে আসতে হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি সিলেট বিভাগের ৪ জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তাদের জরুরী তলব করেছি। তাদেরকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। আগামীকাল ৫ ফেব্রুয়ারী থেকে ছবি তোলা কার্যক্রম শুরু হবে। কেউ বাদ পড়লে সেখানে ভোটার রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ থাকবে।