বড়লেখায় পল্লীবিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ লাইন যেন মৃত্যুফাঁদ
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৬:১৫:০৩ অপরাহ্ন
৩ বছরে একই পরিবারের ৬ জনসহ ৮ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু
আব্দুর রব, বড়লেখা :
বড়লেখার বিভিন্ন এলাকায় বসতবাড়ির রাস্তা এবং পাশ ঘেঁষেই হাতে ছোঁয়া দুরত্বে টানানো রয়েছে পল্লীবিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন লাইন।
মৌলভীবাজার পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতাধীন এসব এলাকায় প্রায় ৪ শতাধিক স্পটে এমন ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন লাইন থাকতে দেখা গেছে। কখনোই সমিতির আঞ্চলিক কার্যালয় মরণফাঁদ এসব বিদ্যুৎ লাইন স্থানান্তরের কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। ফলে অপরিকল্পিতভাবে টানানো এসব সঞ্চালন লাইনে অপ্রত্যাশিত প্রাণহানি ও দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা বাড়ছে। দুর্ঘটনার পর কিংবা গণমাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ লাইন নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে কয়েকদিন তালিকা তৈরির (ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের) তোড়জোড় চলে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বন্ধ হয়ে যায় এসব কার্যক্রম। গত বছর (২০২৪ সাল) পল্লী বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে জুড়ী ও বড়লেখায় একই পরিবারের ৬ জনসহ ৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এর আগে ২০২২ সালে ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে আরও এক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে।
ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন লাইন ও খুঁটির বিষয়ে মৌখিক ও লিখিতভাবে জানালেও পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি এতে সাড়া দিচ্ছে না। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে বাস করছেন এলাকাবাসী। ক্ষোভের সাথে গ্রাহকরা জানান, ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের বিষয়ে অফিসে জানালে উল্টো নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। এ অফিসে (বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ে) কর্মরত কর্মকর্তা ও একটি দালাল সিন্ডিকেট চক্র গ্রাহক হয়রানিতে জড়িত।
শনিবার সরেজমিনে বড়লেখা উপজেলার বর্ণি, দাসেরবাজার, নিজবাহাদুরপুর, বড়লেখা সদর, তালিমপুর ও দক্ষিণভাগ ইউনিয়ন এলাকা ঘুরে ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুতের সঞ্চালনলাইন ও খুঁটি দেখা গেছে। এই কার্যালয়ের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকার (বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার) প্রায় ৪ শতাধিক স্পটে এমন ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন (এলটি ফেজ) লাইন রয়েছে।
উপজেলার নিজ বাহাদুরপুর ইউনিয়নের পকুয়া গ্রামের সত্যেন্দ্র বিশ্বাস তার বাড়ির সামনের ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের বিষয়ে লিখিত আবেদনের পরও দীর্ঘদিন ধরে পল্লীবিদ্যুৎ অফিসে ঘুরছেন। সম্প্রতি তিনি বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের এজিএম (ওএন্ডএম) আশরাফ হায়দারের কাছে একাধিকবার গিয়েছেন। কিন্তু এজিএমের নিকট থেকে কোনো সুরাহা পাচ্ছেন-না।
সত্যেন্দ্র বিশ্বাস বলেন, লাইনগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। হাত দিলে নাগাল মিলে। যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনার আশংকা রয়েছে। অফিসে গেলে কর্মকর্তারা ধমকের সুরে কথা বলেন। এক কর্মকর্তা অন্য কর্মকর্তার টেবিলে পাঠান। অফিসে ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হয়ে যাচ্ছি। অফিসের লোকজন হয়তো কোনো বড় দুর্ঘটনার পর স্পট দেখবেন।
বড়লেখা সদর ইউনিয়নের মহদিকোনা গ্রামের শাহাবুদ্দিনের বাড়ির একটি বসতঘরের ছাদের ওপর ঝুলে পড়ে বিদ্যুতের (এলটি ফেজ) তার। তারগুলো হাত দিলে ছোঁয়া যায়। প্রায় ২ বছর ধরে বিদ্যুত অফিসের লোকজনের কাছে তারা মৌখিকভাবে একাধিকবার জানিয়েও কোনো ফল পাননি। সম্প্রতি তারা বাঁশের খুঁটিতে ঝুলে পড়া বিদ্যুতের লাইনগুলো একটু উঁচু করে রাখেন। এরপরও ছাদে গেলে বিদ্যুতের লাইন ছোঁয়া যায়। এ অবস্থায় শিশু ও বড়দের রক্ষা করতে কাপড়ের নেট জাল টেনে রেখেছেন। এ অবস্থায়ও লাইনটি ঝুঁকিমুক্ত নয়। পরিবারের লোকজন সব সময় আতঙ্কে থাকেন।
একই রকম অবস্থা দেখা গেছে, দাসেরবাজার ইউনিয়নের শংকরপুর গ্রামের মতিন মিয়ার বাড়িতে। মতিন ও তার প্রতিবেশীর বাড়ির ওপর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে টানানো রয়েছে বিদ্যুতের (এলটি ফেজ) সঞ্চালন তার। লাইনগুলো হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। ঝুঁকি এড়াতে এখানেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাঁশ দিয়ে লাইনগুলো উঁচু করে রাখা হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন স্থানীয় অভিযোগ কেন্দ্রে ও বড়লেখা অফিসে একাধিকবার জানিয়েও সমাধান পাননি।
বর্ণি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের গণেষার চক এলাকা ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মুদৎপুর এলাকার বেশ কয়েকটি বাড়িতে হাত ছোঁয়া দুরত্বে এলটি ফেজ লাইন (কভার ছাড়া তার) ও হাইভোল্টেজ বিদ্যুৎ লাইন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দেখা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন লাইনের বিষয়ে পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ে বারবার ধর্না দিয়ে, লিখিত আবেদন করেও মেলেনি সুফল। ঝুঁকিপূর্ণ সঞ্চালন লাইনের বিষয়ে গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়টি বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের চরম গাফিলতি বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজার পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডিজিএম মো. খায়রুল বাকী খান বলেন, যেসব লাইন ঝুঁকিপূর্ণ আছে, হাতের নাগালে আছে; সেগুলো এই মাসের মধ্যে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এগুলো ডিজাইন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাচ্ছি। অতি শীঘ্রই (আগামী মাসের মধ্যে) কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের (২০২৪) ২৫ মার্চ জুড়ীতে (বড়লেখা আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতাধীন) টিনের চালে বিদ্যুৎ লাইন ছিঁড়ে পড়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে একই পরিবারের ৬ জনের মৃত্যু হয়। একই বছরের ২৩ মে বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের খলাগাঁও গ্রামে সন্ধ্যায় প্রবাসীর বসতঘর ছোঁয়া বিদ্যুতের মেইন লাইনে স্পৃষ্ট হয়ে এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এরআগে ২০২২ সালের মে মাসে পল্লীবিদ্যুতের দাসেরবাজার অভিযোগ কেন্দ্রের (তৎকালীন) ইনচার্জের গাফিলতিতে একটি নির্মাণাধীন ভবনে একজন নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তখন পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি ঝুঁকিপূর্ণ লাইন সংস্কারের তোড়জোড় শুরু করে। ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের তালিকা করে তা দ্রুত সংস্কারের কথা গণমাধ্যম ও ভুক্তভোগি গ্রাহকদের জানানো হয়। কিন্তু প্রায় দেড় বছরেও কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি।