জুলাই চার্টার ও সংস্কারে ঐকমত্য চায় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:১৫:৪৬ অপরাহ্ন
* নতুন বাংলাদেশ তৈরীর জন্যই সংস্কার : প্রধান উপদেষ্টা * দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের কথা বলল বিএনপি * সরকারের সকল পজেটিভ সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেবে জামায়াত
জালালাবাদ রিপোর্ট : সংস্কার ও জুলাই চার্টার বা সনদ তৈরির লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের। গতকাল শনিবার হলো কমিশনের সূচনা সংলাপ। এতে অংশ নিলো বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সক্রিয় সব রাজনৈতিক দল।বলা হচ্ছে, গতকালের বৈঠক ছিলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ শুরুর আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু এই বৈঠকেও নির্বাচন এবং এর রোডম্যাপেরও তাগিদ এসেছে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে।
ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গতকাল বেলা ৩টায় বৈঠকে বসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), নাগরিক ঐক্য, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ ২৬টি দল ও জোটের প্রায় ১০০ নেতা অংশ নেন। জাতীয় নাগরিক কমিটিও এই বৈঠকে অংশ নেয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।
বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন ব্যারিষ্টার জমির উদ্দিন সরকার, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন নায়েবে আমীর ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের সদস্য মশিউল আলম।
বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে প্রথম ইনিংস বা প্রথম অধ্যায় শেষ হয়েছে। আজ রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, প্রথম অধ্যায় আমরা যেভাবে কাটালাম, এটা একটা মস্তবড় শক্তি। প্রথম অধ্যায় শেষ করলাম। দ্বিতীয় অধ্যায় যদি ঠিক থাকতে পারি, তৃতীয় অধ্যায়ের জন্য আর আমার কোনো চিন্তা নেই। আমরা নিশ্চয়ই নতুন বাংলাদেশ বানাতে পারব। এ সময় যেসব শক্তি আমাদের ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে, আমাদের ভ-ুল করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, সবাই মিলে সুন্দরভাবে তাদের মোকাবিলা করতে পেরেছি।
দেশ, দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দল ছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের সমর্থন গড়ে উঠেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সে কারণে অপর পক্ষ সুবিধা করতে পারছে না। পদে পদে তারা ব্যাহত হচ্ছে। বহুবার প্ররোচনা করেও গল্প টিকাতে পারছে না তারা। শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অপপ্রচার চালাতে গিয়েও পারেনি তারা। যত ছোট-বড়, মাঝারি ও ধনী রাষ্ট্র-সবাই আমাদের পক্ষে। কারও কোনো দ্বিধা নেই।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন সারা পৃথিবী বদলে দিয়েছে উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এখন কারও বয়ান কেউ শুনবে না। আর কত সমর্থন চাই আমাদের। অক্ষরে অক্ষরে বলে দিয়েছে, কখন কীভাবে মেরেছে (মানুষ)। এর থেকে তো তাদের বের হওয়ার উপায় নেই। বাংলাদেশকে ঘিরে যে অপপ্রচার চলছিল, একটি প্রতিবেদনে সবকিছু সমাপ্ত হয়েছে।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব কাউকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নয় বলে মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আমরা কেবল মাত্র সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি, আমরা শুধু সাচিবিক কাজগুলো আপনাদের করে দিলাম। এটা আমার কাজ না, এটা আপনাদের কাজ, যেহেতু আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজকে বহুল প্রতীক্ষিত একটা বৈঠকে একত্রিত হওয়াতে আমি আনন্দিত। বহুদিন ধরে যারা অপেক্ষা করছিলাম, দিন গুনছিলাম কবে আমরা বসবো। আমাদের প্রতিজ্ঞা হলো আমরা যেন ছাত্র জনতার আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান না করি। যে কারণে তারা আত্মত্যাগ করেছিল, সেটা যেন পরবর্তী প্রজন্ম মনে রাখে।
তিনি বলেন, আগামীতে আইনকানুন এবং সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। নির্বাচনে কেউ জিতলে পরাজিত বা অন্যরা আর সন্দেহ করবে না। ভাববে না যে, কলকাঠি নেড়ে কাউকে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকের শুরুতে ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন তাঁদের স্মরণ করা হয়। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বহু আগে থেকে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন থাকলেও তা করার সুযাগ পাইনি। ছাত্রজনতার ত্যাগের মধ্য দিয়ে সেই সুযোগ আমরা পেয়েছি। আমরা যেন তাঁদের এই আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান না জানাই। পরবর্তী প্রজন্ম যেন তাঁদের মনে রাখে। তাঁদের আত্মত্যাগকে সার্থক করার জন্য আমরা সবাই দাঁড়িয়েছি। সবাইকে মিলে সব রকম চেষ্টা করব, যেন তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যাদের (ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার) বাংলাদেশের মানুষ তাড়িয়ে দিয়েছে, অস্বীকার করেছে, ত্যাগ করেছে তারা ফিরে আসার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল। প্রতিটি দিন তাদের জন্য মূল্যবান দিন। দেরি হলে তাদের জন্য অসুবিধা। সেজন্য আমাদের শক্ত থাকতে হবে মজবুত থাকতে হবে। আমাদের মধ্যে মতভেদ থাকবে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমরা একত্রে নই।
যা বলল বিএনপি :
বৈঠক থেকে বেরিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজ ছিল শুধু ইন্ট্রোডাকশন। বিভিন্ন দল তাদের নিজস্ব মতামত দিয়েছে। পজিটিভ কন্সট্রাকটিভ কিছু আলোচনা হয়নি। আজ পরিচিতির মতো একটা ব্যাপার ছিল। তবে আমরা আশা করব, খুব দ্রুত এই সংস্কারের ন্যূনতম ঐক্যমত্য তৈরি হবে। সেটার ওপর ভিত্তি করে অতিদ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি জাতীয় নির্বাচন আগে হতে হবে, তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম সভায় মিলিত হয়েছেন। এই সভায় তিনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেছেন। দলগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন সংস্কারের যে রিপোর্টগুলো কমিশনগুলো যে জমা দিয়েছে সেগুলোর ওপর আলাপ আলোচনা হবে। দলগুলো এ নিয়ে কমিশনগুলোর সঙ্গে কথা বলবে এবং একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। সেটাই মূল কথা। সেখানে আজকে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন কথা বলেছে।
যা বলল জামায়াত :
বৈঠক থেকে বেরিয়ে নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি ডা: আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকের বলেছেন, সকল পজেটিভ (ইতিবাচক) সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী সমর্থন জানাবে। আমরা বলেছি এই সংস্কার কমিশন তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পরে, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিতে হবে।
ডা: তাহের বলেন, আজকে প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের সাথে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বিভিন্ন দলের সাথে আলাদাভাবে আলোচনা করবেন সে বিষয়ে কথা হয়েছে। আমরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি।
তিনি বলেন, আজকে বিস্তারিত কোনো আলোচনা হয়নি। তারা আমাদেরকে সংস্কারের রিপোর্ট বই দিবেন, সেই বই পর্যালোচনা করে জামায়াত ইসলামী এবং সরকারের যে টিম রয়েছে তাদের সাথে আলাদা বৈঠক হবে। সেখানে আমরা আলোচনা করে মূল সিদ্ধান্ত জানাব। তিনি আরো বলেন, আমরা বলেছি, যে সংস্কারটা প্রয়োজন তাতে আমরা ঐক্যমত এবং যথাসময়ে নির্বাচন দিতে হবে।