অনাগ্রহ-অনিশ্চয়তায় সর্বজনীন পেনশন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩:০০:৫৯ অপরাহ্ন
আরো আকর্ষণীয় করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার || রমজানের আগেই সিলেটে মেলা
জালালাবাদ রিপোর্ট : অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে চালু হয়েছিলো সার্বজনীন পেনশন কর্মসূচী। নিবন্ধন করেছিলেন প্রায় পৌণে ৪ লাখ মানুষ। জমাও হয়েছে প্রায় ১৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এই কর্মসূচি অব্যাহত রেখে আরও আকর্ষণীয় করার কথা বলেছে। এরপরও পেনশন কর্মসূচি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে না।
নিবন্ধিত অনেকে কিস্তির টাকাও জমা দিচ্ছেন না। গত ৬ মাসে নতুন করে নিবন্ধন করার সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, এখন প্রচারণার অভাবে আগ্রহ কমেছে।
সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির সমতা স্কিমের আওতায় নিবন্ধন করার বিষয়ে বিবিসির সাথে বলেন নাসিমা আক্তার নূপুর, যিনি বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার একটি কলেজের প্রভাষক। তিনি বলেন, ৬-৭ মাস আগে সেই যে প্রথম কিস্তিতে ৫০০ টাকা দিয়েছিলাম, এরপর আর সেখানে কোনো টাকা জমা দেওয়া হয় নাই। নিবন্ধন করার পর আমাদের কাছে সেরকম কোনো নির্দেশনাও আসেনি। মাঝে একবার শুনছিলাম যে কিস্তি জমা না দিলে জরিমানা দিতে হবে।
নূপুরের অন্যান্য সহকর্মীরাও ওই স্কিমের আওতায় নিবন্ধন করেছিলেন এবং তারা কেউ-ই ওই কিস্তি ‘কন্টিনিউ’ করছেন না বলে উল্লেখ করেন তিনি।নূপুরের মতো আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা ওই স্কিমের আওতায় নিবন্ধন করেছিলেন ওপর মহলের চাপে পড়ে। কারণ প্রতি মাসে টাকা জমা দেওয়ার পর সরকার আদৌ সেই টাকা তাদেরকে সময়মতো ফেরত দিতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে তারা সন্দিহান ছিলেন।
সেইসাথে, জুলাই-আগস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থান, চাকরিজীবিদের ব্যয় অনুযায়ী আয় না থাকা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি- চাঁদা জমা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের অনীহার পেছনে এগুলোও দায়ী। এসবের কারণে সরকার পতনের পর নতুন করে নিবন্ধনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
তবে মানুষদের মাঝে যে টাকা ফেরত না পাওয়ার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালু হওয়া এই কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে এক ভয়, সেটিকে উড়িয়ে দিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, এই পেনশন কর্মসূচি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্ধ বা বাতিল তো করছেই না, বরং সরকার এই খাতে আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
পেনশন স্কিম নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা :
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশনের চার স্কিমে মোট নিবন্ধন করেছেন ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩০৮ জন। আর এখন পর্যন্ত মোট জমা হয়েছে ১৫৭ কোটি ৯১ লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকা।
পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, গ্রাহকদের বেশিরভাগই সরকার পতনের আগে নিবন্ধন করেছেন। নতুন নিবন্ধনকারীর সংখ্যা আগের তুলনায় কম।কত কম? সেটি তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে না পারলেও জানিয়েছেন, সরকার পতনের পর নিবন্ধনের হার বেড়েছে, সেটি বলবো না। তবে সরকার পতনের পর নিবন্ধনের গতি কমে গেল। কারণ অনেকের মাঝে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এলো, স্কিম থাকবে কি থাকবে না। কিন্তু এখন যেহেতু সরকার বলেছে যে স্কিম থাকবে এবং এটিকে আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ নেওয়া হবে, সুতরাং আমরা এখন সেভাবেই এগোনোর উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছি।
এখন প্রতিদিনই নিবন্ধনকারীর সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে মাসে এখন ২০০-৩০০ করে বাড়ে। আমাদের তো আশা ছিল দিনে ৫০০-৮০০ করে বাড়বে। নতুন করে নিবন্ধন না করার কারণ হিসেবে তিনি প্রচারণার অভাবের কথা বলেন।
মো. গোলাম মোস্তফার মতে, একটি নতুন জিনিস মানুষের মাঝে নিলে তারা দেখতে চাইবে যে এর ফিচারগুলো কী, এটা টেকসই কি না; সেজন্যই প্রচার দরকার হয়। এটি নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করছি।
গণঅভ্যুত্থানের আগে প্রচারণার উদ্দেশ্যে দেশের ৮ বিভাগের দু’টো বিভাগ, রাজশাহী ও রংপুরে মেলার আয়োজন করেছিলো পেনশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের কারণে তাতে পুরোপুরিভাবেই ভাটা পড়ে গত জুলাই-আগস্ট মাসে।
কিন্তু এখন কর্তৃপক্ষ তা কাটিয়ে উঠতে চাইছে। সেজন্যই সরকার পতনের পর এবার প্রথমবারের মতো সিলেটে আরেকটি মেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে তারা এবং সেটি রমজানের আগেই। ৫ আগস্টের আগে আয়োজিত দুই মেলায় ‘ভালো সাড়া’ পেয়েছিলেন জানিয়ে গোলাম মোস্তফা আরও বলেন, এখন আমরা আবার সেটিকে বেগবান করতে চাচ্ছি।
সমস্যা ‘সুবিধায়’ নাকি অন্য কোথাও?
সরকার থেকে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর এবং প্রচারণায় মনোযোগী হওয়ার কথা বলা হলেও ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলছেন, এখানে মূল সমস্যা নিশ্চয়তা, ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে। স্কিমগুলোর যে ডিজাইন যে এত বছর হলে এত টাকা পাবে, সেখানে কোনো সমস্যা নাই। এখানে ইস্যুটা সুযোগ-সুবিধার না। সরকার থেকে যেগুলো অফার করা হয়েছে, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতার অভাব নেই। এখানে ইস্যুটা প্রাতিষ্ঠানিক। ওই ‘সমস্যাগুলো’ ঠিক করা না হলে মানুষ এতে খুব বেশি সাড়া দেবে না বলে মনে করেন তিনি।
তার মতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে “সরকারের পেনশন অথরিটি এই টাকাগুলো ম্যানেজ করবে। সেই টাকা গ্রাহকরা সময়মতো পাবে কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই। আমি যে টাকা দেবো, সেই টাকা পেনশন অথরিটি কীভাবে ম্যানেজ করবে, তার জেনারেল কিছু ধারণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটি পরিষ্কার হয়নি।
তবে গ্রাহকদের মনে চলমান ওই শঙ্কা ও এবং অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণের বিষয়ে পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, এটি যেহেতু সরকারের প্রোগ্রাম, এখানে অনিশ্চয়তার কিছু নাই। গ্রাহকরা সময়মতো টাকা পাবে।