কতটা সম্ভব ডিসেম্বরে নির্বাচন?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩০:৫০ অপরাহ্ন
সাড়ে ১৮ লাখ’ ভোটার হবেন ২৬ এর ২ জানুয়ারী || সীমানা জটিলতা, দল নিবন্ধন ও সংস্কারসহ নানা চ্যালেঞ্জ
জালালাবাদ রিপোর্ট : ‘নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে, স্থানীয় সরকার আগে না জাতীয় নির্বাচন আগে’-এই প্রশ্নে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি বক্তব্য-বিবৃতি। এমন পটভূমিতে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের কথা আসছে ঘুরেফিরে।সর্বশেষ মঙ্গলবার সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও ডিসেম্বর বা তার কাছাকাছি সময়ের মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মধ্যেই সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে ফেলবে বলেও তিনি আশা করেন।
যদিও নাগরিক ভোগান্তি কমাতে অন্তত সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে দ্রুত নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।এর আগে ১৮ ফেব্রুয়ারী আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদেরকে সামনে নিয়ে আসা উচিত।
ওদিকে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে এরই মধ্যে প্রাথমিক কিছু প্রস্তুতি শুরু করেছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন বা ইসি। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন কতটুকু প্রস্তুত? তারা প্রস্তুতির জন্য সময়ইবা পাচ্ছে কতটা?
এই সময়ের মধ্যে ভোট আয়োজন করতে নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, সীমানা নির্ধারণ ও নির্বাচনি আইনগুলোও সংস্কার করতে হবে।কিন্তু সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব চূড়ান্ত না হওয়ায় সীমানা নির্ধারণ, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কিংবা নির্বাচনি আইন ও বিধানগুলো পরিবর্তনের কাজ শুরু করতে পারছে না ইসি। যে কারণে ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন আয়োজন করতেও এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।
গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা।যে কারণে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন অন্তত ১৬টি ক্ষেত্রে দেড়শোটির বেশি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে সরকারের কাছে।
এরমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু, স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার প্রস্তাবও করা হয়েছে।যদিও এসব প্রস্তাব নিয়ে এখনও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো আলোচনা শুরু হয়নি।সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য তৈরিতে গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এ বিষয়ে কাজ শেষ করা হবে বলেও ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য খুব বেশি সময় পাবে না নির্বাচন কমিশন।
যদিও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগের আইনকে সামনে রেখেই তারা নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো সেরে রাখছেন। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজে এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, আগের আইন ধরে প্রস্তুতি নেয়ার পর যদি সংস্কারের মাধ্যমে আইন ও বিধান নতুন করে ঢেলে সাজানো হয় তাহলে অনেক কিছুই নতুন করে শুরু করতে হবে। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী নির্বাচন আয়োজন করতে তাদের বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে।
এদিকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করার বিষয়ও ভাবছে সরকার।নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, যদি ডিসেম্বরকে সামনে রাখি তাহলে আমাদের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে সমস্ত কাজ শেষ করতে হবে এবং সেইভাবেই আমরা এগোচ্ছি।কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা আগামী নির্বাচন প্রস্তুতি শুরু করলেও কিছু কিছু বিষয়ে এখনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।
বড় চ্যালেঞ্জ ভোটার তালিকা :
আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত ২০ জানুয়ারি থেকে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন।গত ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহের নির্ধারিত সময় নতুন করে ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ভোটারের তথ্য সংগ্রহও করেছে ইসি।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে নিবন্ধন কেন্দ্রে এই নতুন ভোটারদের বায়োমেট্রিক (আঙুলের ছাপ ও চোখের মনি বা আইরিশের প্রতিচ্ছবি) তথ্য সংগ্রহ এবং ছবি তোলার কাজ চলছে দেশজুড়ে।হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার এমন প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ নাগরিক ভোটার তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন, যারা ২০২৬ সালের দোসরা জানুয়ারি ভোটারযোগ্য হবেন।
নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে ভোটার তালিকা বিধিতে একটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। না হলে ভোটগ্রহণের তারিখ ২০২৬ সালের ২ জানুয়ারির পরে করতে হবে।
ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট হলে তরুণ ভোটারদের একটা বড় অংশ আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে না, যেটিকে বড় একটি সংকট হিসেবে দেখছে নির্বাচন কমিশন।নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা যদি যৌক্তিক সময় পাই, তখন সংশ্লিষ্ট নীতিমালা সংশোধনের বিষয়গুলো থাকবে। সেগুলো যদি যথা সময়ে করতে পারি তাহলে আমাদের দিক থেকে কোনো অসুবিধা নাই। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নতুন এই সাড়ে ১৮ লাখ ভোটারের বিষয়টি মাথায় রাখবে তারা যেন ভোট দিতে পারে।
ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে গিয়ে নতুন ভোটারের পাশাপাশি মৃত ভোটারদেরও বাদ দেয়া হচ্ছে তালিকা থেকে। এ বছর ২০ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে যে হালনাগাদ কার্যক্রম চলেছে সেখানে নতুন ভোটার যুক্ত করার পাশাপাশি তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে মৃত ভোটারদেরও।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ১৫ লাখেরও বেশি মৃত ভোটারকে বাদ দেয়া হয়েছে তালিকা থেকে। নিয়ম অনুযায়ী, ভোটার তালিকা থেকে মৃত ভোটার বাদ দিতে মৃত সনদের প্রয়োজন হয়।কিন্তু মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলছেন, তৃণমূলের অনেক পরিবারেই মৃত ব্যক্তির তথ্য দিলেও মৃত্যু সনদ দিতে পারছেন না।
সংসদীয় আসনের সীমানা জটিলতা :
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিভিন্ন দাবি-আপত্তির ওপর ভিত্তি করে সংসদীয় আসনের সীমানায় নানা পরিবর্তন এনেছিল অতীতের নির্বাচন কমিশনগুলো।গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ১০টি আসনের সীমানায় পরিবর্তন আনা হয়।নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, জাতীয় সংসদের সীমানায় সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আনা হয় ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে।সে সময় এটিএম শামছুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন কমবেশি শতাধিক আসনের সীমানায় পরিবর্তন এনেছিল।আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ এখনো ঘোষণা হয়নি। তবে এরই মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪১টি সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তনের আবেদন জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে।নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, ভৌগোলিক অখ-তা, জনসংখ্যা ও ভোটার সংখ্যার বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করতে হয়।
নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, অতীতে কোনো কোনো নির্বাচন কমিশন সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই নিয়মগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ না করায় সংসদীয় আসনের সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা রয়েই গেছে।
যে কারণে সরকার নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারে যে কমিশন গঠন করেছিল সেই কমিশন সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন আইনের প্রস্তাব করেছে।যদিও এখনও সেই সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত না হওয়ায় সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করতে পারছে না কমিশন। চলতি মাসে সীমানা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে বৈঠকে করে নির্বাচন কমিশন।নির্বাচন কমিশনের একজন উপ-সচিব জানিয়েছেন, আইনে সংস্কার না হলেও ভোটার সংখ্যা, জনসংখ্যা ও ভৌগোলিক বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে কোন কোন আসনে কী কী পরিবর্তন করা প্রয়োজন সেগুলোর প্রাথমিক তালিকা প্রস্তত করে রাখছে নির্বাচন কমিশন।
তিনি জানান, এরই মধ্যে পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে জনসংখ্যার তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। এরপর উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক যে ভোটার সংখ্যা রয়েছে সেটির তালিকাও তৈরি করা হচ্ছে।তবে শেষ পর্যন্ত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী যদি বড় কোনো পরিবর্তন আসে কিংবা আসন সংখ্যা যদি বাড়ানো হয় সেক্ষেত্রে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা বাড়বে কি-না এমন প্রশ্নও ছিল নির্বাচন কমিশনের কাছে।
জবাবে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, সংস্কারের যে প্রস্তাবনাগুলো আছে সেগুলো কতটুকু আমাদের অ্যাড্রেস করতে হবে সেটির জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। তবে আমরা বিভিন্নভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ ঘোষণা হলে সীমানা জটিলতা নিয়ে আরও বেশি সংখ্যক আবেদন ইসিতে জমা পড়তে পারে।
রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কবে?
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত হতে হয়।২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বিধান চালু করে এটিএম শামছুল হুদার নির্বাচন কমিশন।রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন দল নিবন্ধনে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে ইসি।সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আবেদন করলেও ২০২৩ সালের অক্টোবরে নতুন দুটি রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আদালতের নির্দেশে নতুন করে আরও ৬টি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন। বর্তমানে ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা রয়েছে ৪৯টি।অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেছে। সেক্ষেত্রে এই নির্বাচনের আগে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের গণবিজ্ঞপ্তিও জারি করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে গণবিজ্ঞপ্তি জারির দলগুলোর আবেদন যাচাই-বাছাই, মাঠ পর্যায়ের তথ্য বাছাইসহ পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে অন্তত ৬ মাস প্রয়োজন হয় বলে নির্বাচন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কিন্তু এ নিয়ে এখনও কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় বিষয়টি নিয়ে অনেকটাই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।