হাওর রক্ষা বাঁধ : সময় শেষ হলেও শেষ হয়নি কাজ
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ মার্চ ২০২৫, ৩:০০:৩৩ অপরাহ্ন
পাউবোর দাবী ৯০, হাওর বাঁচাও বলছে ৬০ ভাগ
এমজেএইচ জামিল: চৈত্র মাস আসতে মাত্র ১৩ দিন বাকী। এরপরই বৈশাখ। আশা জাগানিয়া বৈশাখের আগমনে মুখিয়ে আছে হাওরপাড়ের মানুষ। তবে আশার সাথে দুলছে হতাশাও। কারণ একটাই, কষ্টের সোনালী ধান উঠলে দুঃখ ঘুচবে হাওরপাড়ের মানুষের। পাহাড়ি ঢল আর অকাল বন্যার হাত থেকে হাওরপাড়ের মানুষের কষ্টের ফসল রক্ষা করতে হাওরগুলোর চারপাশে নির্মাণ করা হয় উঁচু বাঁধ। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে পানিতে এসব বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরের বছর শুষ্ক মৌসুমে আবার তা সংস্কার করতে হয়।
তবে প্রতি বছরই বাঁধ নির্মাণ কাজে অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। ফলে বৈশাখের দিকে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেই ঢল নেমে আগাম বন্যা দেখা দেয়। এতে তলিয়ে যায় হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান। এবারও সেই দুশ্চিন্তায় কৃষক।
এবারও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি সুনামগঞ্জের হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ। পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবো ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করার দাবী জানালেও হাওর বাঁচাও আন্দোলনের দাবী এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ কাজ হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কষ্টের সোনালী ফসল নিয়ে শঙ্কিত কৃষক। একদিকে ১০ মার্চের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষের প্রতিশ্রুতি পাউবো’র।
জানা গেছে, অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢল থেকে সিলেট অঞ্চলের প্রধান ফসল বোরো রক্ষায় সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবোর কারিগরি সহযোগিতায় চলছে ‘হাওর রক্ষা প্রকল্পে’র কাজ চলছে। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে বাঁধ নির্মাণ, পুনর্নিমাণ ও হাওরে ক্লোজার নির্মাণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজের নির্ধারিত সময়সীমা শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারী) শেষ হয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। পাউবোর দাবি, জেলায় বাঁধের কাজ গড়ে ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ শেষ করতে আরও ১০ দিন সময় বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন তারা। তবে স্থানীয় কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতারা বলছেন, হাওরে বাঁধের কাজ এখনো ৪০ শতাংশ বাকি। অনেক বাঁধে মাটির কাজই শেষ হয়নি। সঠিক সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ঢলে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে বোরো ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
জানা গেছে, দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় সুনামগঞ্জে বৃষ্টির পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। এ কারণে প্রবল বৃষ্টি এবং ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে দেখা দেয় অকালবন্যা। মার্চের দিকে শুরু হওয়া এই বন্যা হাওরের বোরো ধান ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে ধান রক্ষায় প্রতিবছর সুনামগঞ্জ জেলায় হাওরে নির্মাণ করা হয় ফসল রক্ষা বাঁধ।
সুনামগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলার ১২টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরের ৫৮৮ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ শুরু হয় গত ১৫ ডিসেম্বর। বাঁধের কাজ বাস্তবায়ন করতে ৬৮৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়। এ জন্য ১২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। চার কিস্তিতে এই টাকা পরিশোধ হওয়ার কথা। এরই মধ্যে দুই কিস্তির অর্থ ছাড় দেওয়া হয়েছে। তিন নম্বর কিস্তি ছাড় দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
কিন্তু এ বছর বাঁধ নির্মাণ সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারী) শেষ হলেও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় বেশির ভাগ বাঁধের কাজ এখনো শেষ হয়নি। হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতা ও কৃষকদের দাবি, এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়নি। একই সঙ্গে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। যদিও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বাঁধের কাজ ইতোমধ্যে ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে।
এদিকে সুনামগঞ্জে বাঁধের কাজে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার প্রতিবাদে গত বুধবার শহরের মানববন্ধন করেছে ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় কমিটি। ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ১১ ডিসেম্বর বোরো ফসল রক্ষায় বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এই সময়ে পিআইসি গঠন করা হয়নি। অনেক হাওরে পিআইসি গঠনে অনিয়ম হয়েছে। দেরিতে বাঁধের কাজ শুরু হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়নি। কাজে রয়েছে ব্যাপক অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম। রাজনৈতিক নেতারা পিআইসি ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। গণশুনানি না হওয়ায় কাজে ব্যাপক গাফিলতি দেখা গেছে। বাঁধে দুরমুজ দেওয়া হয়নি।
মানববন্ধনে বক্তারা আরও বলেন, পিআইসি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ইচ্ছেমতো কাজ করেন আর পাউবো সুনামগঞ্জে বসে কাজের অগ্রগতির প্রতিবেদন তৈরি করে। আমরা এই অগ্রগতির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করি। এ বছর বাঁধের অনিয়ম, দুর্নীতিতে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাঁদের অবহেলায় হাওরের ফসল নষ্ট হবে, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। প্রয়োজনে জেলা প্রশাসন ও পাউবোর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
স্থানীয়রা জানান, অনেক স্থানে শুধু বাঁধের ওপর মাটি ফেলা হয়েছে। কম্পেকশন বা ড্রেসিং হয়নি। কিছু জায়গায় এক্সভেটর দিয়ে মাঠি ভরাট করা হলেও কাজের গতি মন্তর। তবে কোনো কোনো স্থানে বাঁধের গায়ে দুর্বাঘাসও লাগানো হচ্ছে। কিছু জায়গায় পুরনো বাধেঁর উপর সামান্য মাটি দিয়ে ঘাস লাগানো হয়েছে। ঘাস তুলতেই পুরনো মাটি বেরিয়ে যায়। পাউবো কথিত পিআইসি গঠনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করছে আমাদের কষ্টের ফসলকে হুমকীর মুখে ফেলে দিয়েছে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, হাওর রক্ষা বাঁধ নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। ৫ আগস্টের পরে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে শুধুমাত্র হাত বদল হয়েছে। হাওর রক্ষা বাঁধের নামে লুটপাট থেমে নেই। এবছরও হাওর রক্ষা বাঁধের কাজের অবস্থা খুবই নাজুক। এখন পর্যন্ত মাটি ফেলার কাজ চলমান। এবার যদি হাওরের ফসল পানিতে তলিয়ে যায়, তার দায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিতে হবে। তাঁদের বিরুদ্ধে আমরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলব, প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নেব।
পাউবো সুনামগঞ্জ জানায়, শনিবার (১ মার্চ) পর্যন্ত জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে শান্তিগঞ্জ উপজেলায় ৯৫ শতাংশ, দিরাই ৮৯ শতাংশ, শাল্লায় ৮৮ শতাংশ, জগন্নাথপুরে ৯১ শতাংশ, দোয়ারাবাজারে ৯১ শতাংশ, ছাতকে ৮৯ শতাংশ, সদর উপজেলায় ৯৪ শতাংশ, বিশ^ম্ভরপুরে ৯৩ শতাংশ, ধর্মপাশায় ৯১ শতাংশ, তাহিরপুরে ৯০ শতাংশ, জামালগঞ্জে ৯১ শতাংশ ও মধ্যনগরে ৯২ শতাংশ বাঁধের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, কিছু কিছু জায়গায় মাটির কাজ চলছে। তবে জেলার হাওরগুলোর ফসল রক্ষা বাঁধের কাজের ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে আমরা ১০ দিনের সময় আবেদন করেছি। বর্ধিত সময়ের মধ্যেই শতভাগ কাজ শেষ করা সম্ভব। হাওর বাঁচাও আন্দোলন নেতৃবৃন্দের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, উনারা যদি অনিয়ম ও বাকী থাকা বাঁধের স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারেন তাহলে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবো। আমাদের টীম প্রতিদিনই সরেজমিনে পরিদর্শন করে বাঁধ নির্মানের অগ্রগতি রিপোর্ট সংগ্রহ করছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তফা ইকবাল আজাদ দৈনিক জালালাবাদকে জানান, সিলেট বিভাগের মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি বোরো ধান উৎপাদন হয়ে থাকে। ১২ উপজেলার প্রকৃতি নির্ভর মৌসুমী এ ফসল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত ফসল জাতীয় খাদ্য ভা-ারে যুক্ত হয়। এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। সব ঠিক থাকলে এবছর ৯ লক্ষ ৪৩ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন ধান পাওয়া যাবে।
তিনি জানান, খাসিয়া ও জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে জেলা অসংখ্য নদী ও হাওর বেষ্টিত জেলায় মৌসুমের শুরুতেই অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নেমে অকাল বন্যা দেখা দেয়। তখন ফসলের মাঠ, বাড়িঘর বিপন্ন হয়ে পড়ে। তাই এই জেলার মানুষের কাছে হাওর রক্ষা বাঁধ নিয়ে আগ্রহ বেশী থাকে।