অবশেষে এমপিওভুক্ত হচ্ছেন ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ মার্চ ২০২৫, ১০:১৭:৩৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক : দীর্ঘ ৪০ বছর পর ভাগ্য খুলতে যাচ্ছে দেশের ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের। প্রথমবারের মতো নিবন্ধিত ১ হাজার ৫১৯টি ইবতেদায়ী মাদ্রাসা এবং সেখানে কর্মরত শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মে মাস থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বেতন-ভাতা পেতে পারেন। এসব শিক্ষকের এমপিও দিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট থেকে ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাবনা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো ইবতেদায়ী মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্ত করতে যাচ্ছে সরকার। এর আগে কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন সচিবের নেতৃত্বে শিক্ষকদের দুঃখ মোচনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের হিসাবে বর্তমানে দেশে ৬ হাজার ৯৯৭টি (কোডভুক্ত) স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা আছে। এ ছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাবে আরও পাঁচ হাজারের মতো মাদ্রাসা আছে। তার মধ্যে এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শনাক্তকারী নম্বর (ইআইআইএন) আছে ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার। প্রথম ধাপে এসব প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হবে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের একজন প্রধান ধরে মোট চারজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হবেন। সেই হিসাবে ৬ হাজার ৭৬ জন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারেন। এতে সরকারের খরচ হবে ১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি।
কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, দেশে প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে। কোন প্রেক্ষাপটে, কীভাবে এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে তার সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হচ্ছে।
মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করার পেছনে মন্ত্রণালয়ের যুক্তি হলো- স্বাধীনতার পর কয়েক ধাপে প্রাথমিক স্কুল জাতীয়করণ হলেও একই স্তরের ইবতেদায়ী মাদ্রাসাকে জাতীয়করণ তো দূরের কথা শিক্ষকদের ন্যূনতম সুবিধা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। বিগত সরকার কয়েক দফায় এ উদ্যোগ নিলেও শেষ মুহূর্তে অদৃশ্য কারণে তা আটকে যায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোকে এমপিওভুক্ত করতে বাজেট সংকুলান করেও শেষ মুহূর্তে তা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ১ হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাকে এমপিওভুক্ত করার জন্য সারসংক্ষেপ তৈরি করার কাজ শেষ। এখন প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানোর আগে শেষ মুহূর্তের যাচাই-বাছাই চলছে।
জানতে চাইলে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, এটা নিয়ে কাজ চলছে। খুবই শিগগিরই এ সংক্রান্ত সামারি (সারসংক্ষেপ) প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো হবে। আমরা চেষ্টা করছি, মে মাসের মধ্যে শিক্ষকরা যেন বেতন-ভাতা পান। তবে পুরোটা নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।
এদিকে গত ২৮ জানুয়ারি ইবতেদায়ী মাদ্রাসাকে জাতীয়করণের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ করেন শিক্ষকরা। তাদের সরানোর জন্য কয়েক দফা পুলিশ জলকামান নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে। এতেও শিক্ষকরা সেখান থেকে সরেননি। এরপর সরকারের পক্ষ হয়ে শাহবাগে যান কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব এস এম মাসুদুল হক। সেসময় তিনি শিক্ষকদের জানান, সারাদেশে অনুদানভুক্ত ১ হাজার ৫১৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাকে পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করবে সরকার। এ বছর থেকে আমরা এমপিওর কাজ শুরু করব।
জাতীয়করণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সচিব খ ম কবিরুল ইসলাম বলেন, জাতীয়করণ করতে পারে কেবল রাজনৈতিক সরকার। আপাতত আমাদের যেটুকু সক্ষমতা আছে তা নিয়ে এমপিওভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।
তিনি আরও জানান, এই ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার বাইরে যেসব ইবতেদায়ী মাদ্রাসা আছে সেগুলোকেও সরকারের নীতিমালা ও নিবন্ধনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে সব মাদ্রাসাকে এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট আইডেন্টিফিকেশন নম্বর বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শনাক্তকারী নম্বর (ইআইআইএন) দেওয়ার চেষ্টা করছি।
প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী মাদ্রাসার মধ্যে বৈষম্যের বিষয়টি স্বীকার করে সচিব বলেন, প্রাথমিকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু যারা মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে তারা ফিডার সিস্টেম পায় না।
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত একই পদ্ধতিতে পাঠদান করান প্রাথমিক স্কুল ও ইবতেদায়ী শিক্ষকরা। সারা দেশে ৬৫ হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা ১১ ও ১৩ গ্রেড অনুযায়ী প্রতি মাসে বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ সব ধরনের সুবিধা পান। অন্যদিকে প্রাথমিকের মতো মাদ্রাসায় একই শ্রেণিতে পড়ার সুযোগ আছে এমন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সংখ্যা ৮ হাজার ৯৭২টি। প্রতিটি মাদ্রাসায় পাঁচজন করে ধরলে শিক্ষক আছেন ৪৪ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৫১৯টি মাদ্রাসার সাড়ে চার হাজার শিক্ষক নামকাওয়াস্তে অনুদান পান। বাকি ৪০ হাজার শিক্ষক বছরের পর বছর বিনা বেতনে পাঠদানে নিয়োজিত আছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৪০ বছর ধরে সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার চরম বৈষম্য চলছে। সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে শিক্ষা প্রশাসনের উদাসীনতায় এভাবে অমানবিকভাবে রয়েছেন এই স্তরের শিক্ষকরা। তারা দাবি আদায়ে বিভিন্ন সময়ে মাঠে নামলেও কোনো লাভ হয়নি।
শিক্ষকরা বলছেন, মূলত মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তর ইতবেদায়িকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় না নেওয়ার কারণে সমস্যা তৈরি হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার প্রাথমিক স্তর যখন রেজিস্ট্রেশন হয়, তখন ইবতেদায়ী মাদ্রাসাও রেজিস্ট্রেশন হয়। কিন্তু ২০০৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বতন্ত্র হিসেবে যাত্রা করলেও তারা মাদ্রাসার এই স্তরটিকে নিতে আগ্রহ দেখায়নি। এ কারণে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে যায়। আর পদে পদে বঞ্চিত হতে থাকে। ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা কোনো বেতন-ভাতা বা আর্থিক অনুদান পান না। ধর্মের প্রতি ভালোবাসা থেকে তারা এই পাঠদান করে যাচ্ছেন বলে দাবি করেন শিক্ষকরা।