গ্রীস্মে বিদ্যুতের দুশ্চিন্তা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মার্চ ২০২৫, ১২:৪০:৫৫ অপরাহ্ন
২৫ ডিগ্রির নিচে এসি, নজরদারি নিয়ে কৌতুহল
জালালাবাদ রিপোর্ট : গ্রীস্ম শুরুর আগে বরাবরই দুশ্চিন্তা থাকে বিদ্যুৎ নিয়ে। এবারও সেই একই দুশ্চিন্তা বিশেষজ্ঞদের। এরমাঝে এবার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকার আভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। এ অবস্থায় এবারের গ্রীস্মে বিদ্যুৎ সংকট প্রকট হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে তীব্র সংকটের মুখে পড়েছিল বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাত। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের গত প্রায় ৭ মাসে সেই পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, পরিস্থিতি খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে আমরা দেখছি না। সংকটগুলো রয়েই গেছে। গত কয়েক বছর ধরেই বিদ্যুৎখাতের প্রধান সংকটের জায়গা হলো জ্বালানি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামীলীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করেই অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
ফলে ৩১ হাজার মেগাওয়াটের উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও সেটার অর্ধেক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারকে। তারওপর বিদ্যুৎ আমদানির বকেয়াও পরিশোধ করতে হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার হিসেবেই, বর্তমানে দেশে দৈনিক প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে দেশীয় উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে গ্যাসের সরবরাহ করা রয়েছে দুই হাজার আটশ’ মিলিয়ন ঘনফুট।
অর্থাৎ দৈনিক প্রায় ১ হাজার দুইশ’ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলোতে।
অন্যদিকে, ডলার সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় গ্যাস, কয়লা এবং জ্বালানি তেলের পুরোটা আমদানি করাও সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে জ্বালানি সংকটে ইতোমধ্যেই বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকগুলো কেন্দ্র ধুকছে।
এর মধ্যেই এবার রোজা, সেচ মৌসুম এবং গরম একসঙ্গে শুরু হওয়ায় বিদ্যুতের ওপর বাড়তি চাপ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, বলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম।
যদিও বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে যে, এখন পর্যন্ত তারা দৈনিক সাড়ে বারো হাজার মেগাওয়াট চাহিদার পুরোটা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে।
তারপরও অনেক এলাকায়, বিশেষতঃ ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের এক থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হতে দেখা যাচ্ছে। যদিও উপদেষ্টা বলছেন, কারিগরি ত্রুটির কারণেই কিছু এলাকায় বিভ্রাট দেখো যাচ্ছে।
উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এটা মূলত কারিগরি ত্রুটি, যেমন: ডিস্ট্রিবিউশন লাইন বা ট্রান্সফর্মারের সমস্যার কারণে ঘটছে। উৎপাদন স্বল্পতার কারণে নয়।
সরকার বলছে যে, এখন পর্যন্ত তারা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছেন। তবে গরম বাড়তে শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সেজন্য আগেভাগেই সাশ্রয়ী নীতিতে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
সামনে সংকট বাড়বে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনে গরমের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। তখন গরমে বিদ্যুতের চাহিদা কতটুকু বাড়ে এবং সেই চাহিদা পূরণে সরকার বিদ্যুতের জ্বালানির যোগান কতটুকু দিতে পারেন, তার ওপর লোডশেডিং নির্ভর করবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে ইতোমধ্যেই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, এবছরেও গ্রীষ্মের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকবে। তাই সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুতের জ্বালানির সরবরাহ বাড়ানোর প্রতিই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, উৎপাদনের ক্যাপাসিটি আমাদের রয়েছে। এখন জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে কোনো সমস্যা থাকবে না। ফলে সরকারকে এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকারও বলছে যে, তারা ইতোমধ্যেই পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন।
বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেন, আমরা অতিরিক্ত চারটা কার্গো আনতেছি এলএনজি গ্যাস। কার্গোগুলো চলতি রমজান মাসেই চলে আসবে। এছাড়া কয়লার সরবরাহও যেন ঠিক থাকে, সেই ব্যবস্থাও করা হচ্ছে বলে জানান উপদেষ্টো।
সরকার বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, ওমানসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে গ্যাস আমদানি করছে। আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশেও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা। ২০২৫ সালের মধ্যে অন্তত ৩৫টি কূপ খনন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
২৫ ডিগ্রির নিচে এসি, নজরদারি হবে কীভাবে?
দেশে সরকারি-বেসরকারি অফিস ও বাড়িঘরে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি না চালানোর নির্দেশনা দিয়ে সম্প্রতি পরিপত্র জারি করেছে সরকার।
কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এয়ার কন্ডিশনারের (এসি) তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে না রাখার যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নে কীভাবে নজরদারি করা হবে তা নিয়ে মানুষের মধ্যে বেশ কৌতুহল তৈরি হয়েছে।
এ ধরনের কাজে আদৌ নজরদারি করা সম্ভব কী-না, সেই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। তবে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলছেন যে, নির্দেশনা বাস্তবায়নে তাদের পরিকল্পনা পরিষ্কার এবং মোটেও কঠিন কিছু হবে না।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ যেহেতু একটা ফিডারের মাধ্যমে যায়, কাজেই সেই ফিডার পর্যবেক্ষণ করে দেখা হবে যে, কোথায় স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে।
এক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচের বিষয়টি সনাক্ত করা হবে কীভাবে? আমাদের কাছে তো আগের সব তথ্য রয়েছে। আমরা তো জানি যে, ফিডারে গতকাল কত ছিল, আজকে কত হলো। শীতকালে কত ছিল এবং গরমকালে এসে কত বাড়লো, সেই তথ্য দেখলে বিষয়টা বোঝা যাবে।
বিদ্যুৎ ব্যবহারের তথ্যে অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেলে সরেজমিনে গিয়ে বিষয়টি তদন্ত করা হবে বলে জানাচ্ছে মন্ত্রণালয়।
যদি দেখা যায় যে, জেনুইন বা যৌক্তিক কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে, তাহলে সমস্যা নাই। কিন্তু অকারণে অপচয় করা হয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলছিলেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা।
এভাবে সংকট কমবে?
২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এসি না চালানোর জন্য সরকারের তরফ থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, আসন্ন সংকট মোকাবিলায় সেটি কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, গ্রাহক পর্যায়ে হঠাৎ এ ধরনের আবেদন করে সফল হওয়ার নজির বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায়নি।
তবে সরকারি অফিস ও বাণিজ্যিক মলগুলোকে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা গেলে সংকট কিছুটা কমতে পারে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। এসব জায়গাগুলোতে যদি ঠিকমত মনিটর করা হয়, তাহলে হয়তো কিছুটা ডিমান্ড কমানো সম্ভব হবে।