বাড়ছে প্রকল্পের মেয়াদ, হচ্ছে অর্থের অপচয়
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মার্চ ২০২৫, ১০:০৬:১৮ অপরাহ্ন
৭ মাসে ১৪২ প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব
জালালাবাদ ডেস্ক : গণহারে বৃদ্ধি করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্পের মেয়াদ। এতে একদিকে যেমন বাড়ছে প্রকল্পের ব্যয়, অন্যদিকে জনসাধারণও বঞ্চিত হচ্ছে উন্নয়ন সুবিধা থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামর্থ্যের চেয়ে বেশি প্রকল্প হাতে নেওয়ার কারণেই নির্ধারিত সময়ে কাজ সমাপ্ত হচ্ছে না। আবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়া মানেই ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে পরামর্শ ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও কোনো কাজই হচ্ছে না।
চলতি অর্থবছরের প্রকল্প বাস্তবায়ন চিত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির হিড়িক পড়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ১৪২টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পেয়েছে, যার মধ্যে বাস্তবায়ন তদারকি ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ১৩৬টির মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। এদিকে, কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ গত মাসে পরিকল্পনা কমিশন এবং আইএমইডির কাছে ৫০টিরও বেশি নতুন প্রস্তাব জমা দিয়েছে, যার মধ্যে ছয়টির মামলা বিচারাধীন।
উন্নয়ন বিশ্লেষকদের মতে, প্রকল্পের সময় বাড়ানোর কারণে আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। কিছু যৌক্তিক কারণে দু-একটি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। গণহারে বৃদ্ধি অযৌক্তিক। এখানে ছোট-বড় প্রকল্পের কোনো ভেদাভেদ নেই। প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের করের টাকার এমন অপচয়ের নজির পৃথিবীর কোথাও নেই।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এডিপির আওতাধীন প্রকল্পগুলোকে বছরের পর বছর ধরে স্থগিত রাখার কৌশল হিসেবে প্রায়ই ‘ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই সময় বৃদ্ধির’ বিধানের অপব্যবহার করা হয়। এভাবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়া মানেই ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। কারণ যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সম্পৃক্ত থাকা বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও বেতন-ভাতার জন্য ব্যয় করতে হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। সাধারণত একটি প্রকল্পে রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের বাইরেও থাকে প্রায় ১১ ধরনের ভাতা।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রকল্প কর্তৃপক্ষের ‘ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ বৃদ্ধির’ অনুরোধ অনুমোদন করা মানেই শেষ পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধির দিকে ধাবিত হওয়া। এই ধরনের প্রস্তাবগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতাকে বৈধতা দেয়। একই সঙ্গে বাড়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন খরচ। এসব প্রকল্প পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের পাশাপাশি কী কারণে বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে, তার সঠিক মূল্যায়ন জরুরি।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১১ সালে ৮৫৬ কোটি টাকা বাজেটে অনুমোদিত চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পটি ২০১৪ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত মেয়াদে তো শেষ হয়নি, বরং বারবার বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ। প্রাথমিকভাবে দুটি সংশোধনীর মাধ্যমে মেয়াদ ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পরবর্তী সময়ে খরচ না বাড়িয়ে আরও দুবার মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরে তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এরপর ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি ২০২২ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয় মেয়াদ।
যদিও চতুর্থ সংশোধনীতে সময়সীমা ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল, পরে আবার মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। বারবার সংশোধনের পরও চার বছরের প্রকল্পটি ১৩ বছরেও শেষ হয়নি। কিন্তু ব্যয় বেড়েছে প্রায় চার গুণ। নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় ৮৫৬ কোটি টাকার প্রকল্প খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সম্প্রতি বৃহত্তর ঢাকা টেকসই নগর পরিবহন প্রকল্পের মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও এক বছরের জন্য বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ২০১২ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি ২০১৫ সালে শেষ
হওয়ার কথা ছিল। এমনকি পরে প্রকল্পের কিছু অংশ বাদ দেওয়া এবং কয়েক ধাপে মেয়াদ বাড়ানোতে ব্যয় ১০৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই ছয়টি অবকাঠামো প্রকল্পের সম্প্রসারণের অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া বাস্তবায়নকারী সংস্থা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন এবং একনেক পর্যায়ক্রমে অনুমোদন প্রক্রিয়ার অধীনে এই প্রকল্পগুলো এরই মধ্যে কমপক্ষে চারটি ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।