দেশের বাজারে ৫৫ হাজার কোটি টাকার ভারতীয় চোরাই কাপড়
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০২৫, ১০:৩৫:০৯ অপরাহ্ন
গোয়েন্দা অনুসন্ধানে তথ্য
জালালাবাদ রিপোর্ট : কখনও পাথরভর্তি ট্রাক, কখনও কুরিয়ার সার্ভিস আবার কখনও বিপণিবিতানের কর্মীদের মাধ্যমে দেশে আসছে ভারতীয় চোরাই কাপড়। আবার কখনও ভারতীয় চোরাকারবারিরা সীমান্ত পার করে দিলেই দেশী চোরাকারবারিরা বিভিন্ন উপায়ে নিয়ে দেশের বিভিন্ন বিপণিবিতানে পৌঁছে দিচ্ছে। আর পণ্যের দাম হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ভারতে। চোরাই পথে ভারতীয় এসব পণ্য দেশে আসার ফলে একদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশীয় কোম্পানিগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অনুসন্ধানে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য ওঠে এসেছে।
জানা গেছে, বিশেষ করে শাড়ি, থান কাপড়, লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবি ও তৈরি পোশাক। স্থল, নৌ ও আকাশÑএই তিন পণ্যে এসব পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। দামি পণ্যগুলো আকাশপথে আর কমদামি পণ্যগুলো স্থলপথে দেশে আসছে।
গোয়েন্দা অনুসন্ধান বলছে, দেশে প্রতিবছর ভারত থেকে চোরাই পথে বাংলাদেশে প্রায় ৪৫০ কোটি ডলারের থান কাপড়, শাড়ি, লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবি ও তৈরি পোশাক প্রবেশ করে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা (এক ডলার সমান ১২২ টাকা হিসেবে)। চোরাচালান ও রাজস্ব ফাঁকিরোধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে বিশেষ প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধান অনুযায়ী, ভারতের আহমেদাবাদ ও কলকাতাÑএই দুই জায়গা হতে স্থল, নৌ ও আকাশপথে বাংলাদেশে এসব চোরাচালান ও রাজস্ব ফাঁকি দেয়া পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে। স্থলপথে আহমেদাবাদ হতে প্রথমে করিমগঞ্জ ও আগারতলা চোরাইপণ্য আসে। এই দুই জায়গা হতে কিছু পণ্য নৌপথে আবার বেশিরভাগ পণ্য স্থলপথে সিলেট, ফেনী, ময়মনসিংহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পাথরভর্তি ট্রাক, কুরিয়ার সার্ভিস ও নিজেরা বহনÑএই তিন উপায়ে পণ্য আসে, যা দেশের বিভিন্ন শহরের বিপণিবিতানে বিভিন্ন উপায়ে চলে যায়। আবার কলকাতা হতে স্থল ও আকাশÑএই দুই পথে দেশে এসব চোরাই পণ্য প্রবেশ করে। কলকাতা হতে সরাসরি বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরার স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন দেশে প্রবেশ করে দেশের বিভিন্ন জেলার বিপণিবিতানে চলে যায়। আবার কলকাতা হতে আকাশ পথে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে চোরাই পণ্য দেশে প্রবেশ করে, যা দেশের বিভিন্ন জেলার নামিদামি বিপণিবিতানে চলে যায়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভারত থেকে স্থল, নৌ ও আকাশÑএ তিন পথেই বাংলাদেশে শাড়ি প্রবেশ করে। শুল্কমুক্ত বিভিন্ন পণ্যের চালানের মধ্যেও স্থল বা নৌপথে বিপুল পরিমাণ থান কাপড়, শাড়ি, লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবি এবং তৈরি পোশাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বিশেষ করে স্থল ও নৌপথে যন্ত্রাংশবাহী যেসব কনটেইনার বাংলাদেশে আসেÑসেগুলোর সঙ্গে এই ধরনের পণ্য আসে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় অংশে জাহাজীকরণ তথ্যে পণ্য রপ্তানির বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশ অংশে তার কোনো উল্লেখ থাকে না বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় এজেন্টরা ভারতের আহমেদাবাদ হতে থান কাপড়, শাড়ি, লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবি ও তৈরি পোশাকের চোরাচালান ভারতের করিমগঞ্জ হতে সিলেট এবং আগরতলা পর্যন্ত পৌঁছে দেন। পরবর্তী সময় এসব পণ্য পাথরভর্তি ট্রাকে (পাথরের নিচে কাপড়) এবং নৌপথে ঢাকায় আনা হয়। খাত সংশ্লিষ্টদের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৪৫০ কোটি ডলারের থান কাপড়, শাড়ি, লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবি ও তৈরি পোশাক, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা (এক ডলার সমান ১২২ টাকা হিসেবে)। এর মধ্যে ১৮০ কোটি ডলারের (২১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা) শাড়ি, ১১২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের (১৩ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা) থান কাপড় ও ১৫৭ দশমিক ৫ কোটি ডলারের (১৯ হাজার ২১৫ কোটি টাকা) তৈরি পোশাক পণ্য বাংলাদেশে চোরাই পথে প্রবেশ করে।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিপণিবিতানগুলোয় প্রতিনিয়ত ভারতীয় শাড়ি বিক্রি হয়। অথচ দেশে আসা ভারতীয় শাড়ির সিংহভাগই অবৈধ ও অননুমোদিত উপায়ে দেশে প্রবেশ করছে। ভারত থেকে বৈধপথে ২০১৯-২০ অর্থবছর ৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছর ৫৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছর ৫৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছর ৫৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ও সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর ৩৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকার শাড়ি আমদানি হয়েছে। অথচ বৈধ পথের চেয়ে অবৈধ পথে কয়েক গুণ বেশি শাড়ি দেশে প্রবেশ করেছে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু চোরাকারবারি গ্রুপ চোরাই পথে শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে ভারত থেকে কাপড় ও তৈরি পোশাক এনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে সরবরাহ করে। সারা বছর অল্প পরিমাণে আনা হলেও ঈদ ও পূজাকে সামনে রেখে চোরাকারবারিরা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বেশি পরিমাণে চোরাই পথে নিয়ে আসে।
প্রতিবেদন বলছে, কিছুসংখ্যক ভারতীয় চোরাকারবারি দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ওই এলাকায় থাকা এসএ পরিবহন ও সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসে এসে পণ্য পৌঁছে দিয়ে যায়। এসব পণ্য ওই কুরিয়ারের গাড়িতে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে পৌঁছে দেয়। কুরিয়ার সার্ভিসের দুর্বল নিয়মনীতির সুযোগে অসাধু ব্যক্তিরা তাদের চোরাচালান কর্মকা- অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিণে নতুন বিধিমালা করা হলে এসএ পরিবহনসহ কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিস হাইকোর্টে রিট আবেদন করায় বিধিমালাটি স্থগিত করে। ফলে চলমান কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। রিটের কারণে বিধিমালা স্থগিত থাকায় কুরিয়ারে অবৈধ পণ্য পরিবহনের ঝুঁকি বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চোরাকারবারিরা সীমান্ত হাটের দিনে সংশ্লিষ্ট সীমান্ত হাট এলাকার নারীদের দৈনিক ১৫ থেকে ২০ বার পাঠিয়ে কাপড় ভর্তি ব্যাগ কার্গোতে তুলে দেয়। সীমান্ত হাটের দিনে ৫০ থেকে ১০০ ডলারের মালামাল আনয়নের আইন বিদ্যমান থাকলেও বিজিবি এবং বিএসএফ’কে ম্যানেজ করে অতিরিক্ত পোশাক বাংলাদেশে চোরাকারবারিরা নিয়ে আসেন।
ভারত থেকে চোরাই পথে দেশে আসা কাপড় ও পোশাক আমদানি বন্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের যেসব সীমান্ত দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে এসব পণ্য আসছেÑসেসব সীমান্ত এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) টহল সংখ্যা বৃদ্ধি করার সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে বন্দরগুলো দিয়ে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণা ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং এর সঙ্গে জড়িত কাস্টমস কর্মকর্তা ও আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কুরিয়ার সার্ভিস সম্পর্কিত প্রণয়নকৃত খসড়া বিধিমালার বিপরীতে কতিপয় কুরিয়ার সার্ভিস কর্তৃক রিটের দ্রুত নিষ্পত্তি করে বিধিমালাটির যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থা করা।