থামছে না সড়ক দুর্ঘটনা, বিচার হয় কতজনের?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩৮:০৩ অপরাহ্ন
ঈদুল ফিতরে ৯ বছরে ২,৩৭৭ দুর্ঘটনা, নিহত ২৭১৪
জালালাবাদ রিপোর্ট : থামছেনা সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে প্রাণ, পঙ্গু হচ্ছেন অনেকে। ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোনো না কোনো স্থান থেকে সড়ক দুর্ঘটনার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এসব দুর্ঘটনায় কেউ ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ আবার গুরুতর আহত হয়েছেন। গত ৯ বছরে শুধু ঈদুল ফিতরের সময় ২ হাজার ৩৭৭ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৭১৪ জন। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এসব মৃত্যুর বিচিার কী হচ্ছে?
সম্প্রতি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের একটি সড়ক দুর্ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। গত ২ এপ্রিল চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকার ওই সড়ক দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মাঝে পাঁচ জনই একই পরিবারের।
ঈদের ছুটি কাটাতে পরিবারের সবাই মিলে কক্সবাজারে যেতে চেয়েছিলো বরিশালের পিরোজপুর জেলার ওই পরিবারটি। কিন্তু ফেরার পথে একটি দুর্ঘটনায় সবাই প্রাণ হারান।ঘটনাটি গণমাধ্যমে এলে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে দুঃখপ্রকাশ কিংবা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনেকেই বাংলাদেশের সামগ্রিক সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।ঈদের আগের ৭দিন, ঈদের দিন ও ঈদের পরের দিন- এই মোট ১৫ দিনকে ঈদযাত্রা হিসাবে ধরা হয়। ওই হিসাবে গত ৩১ মার্চ ঈদ হওয়ায় এবারের ঈদ যাত্রা এখনও শেষ হয়নি।
ফলে এবারের ঈদ যাত্রায় মোট কতগুলো সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে, তার কোনও পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনও কোনো মাধ্যম থেকে পাওয়া যায়নি।তবে সড়কে অব্যবস্থাপনা, দুর্ঘটনা রোধ ও যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এবারের ঈদের সড়ক দুর্ঘটনা একটি প্রাথমিক তথ্য বিবিসিকে দিয়েছে।
তাদের প্রাথমিক হিসাবে ঈদের আগে-পরে মিলিয়ে, গত ২৪ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে মোট ২১৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ২৩৯ জন এবং আহতের সংখ্যা ৫১৬ জন। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক জানান, এখনও ঈদযাত্রা শেষ হয়নি এবং অনেক তথ্য আসেনি। ফলে দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা তাদের প্রাথমিক পরিসংখ্যান থেকে বেড়ে যেতে পারে। যাত্রী কল্যাণ সমিতি’র হিসাবে, গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ঈদুল ফিতরের আগে-পরে মিলিয়ে ১৫ দিনে সড়কে ৩৯৯টি দুর্ঘটনা ঘটে, যাতে ৪০৭ জন নিহত এবং এক হাজার ৩৯৮ জন আহত হয়।
এর আগের বছর ২০২৩ সালের রোজার ঈদের ১৫ দিনে সড়কে ৩০৪টি দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছিলো ৩২৮ জনের। আর, সে সময় আহত হয়েছিলেন ৫৬৫ জন।এছাড়া বিগত ৯ বছরে শুধুমাত্র ঈদুল ফিতরে সারাদেশে ২ হাজার ৩৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৭১৪ জন নিহত এবং ৭ হাজার ৪২০ জন আহত হয়েছেন বলে জানায় সংগঠনটি।
কেন ঠেকানো যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল?
পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় আন্দোলন হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় পরিসরে আন্দোলন হয়েছিলো ২০১৮ সালে।ওই বছরের ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত এবং আরও কয়েকজন আহত হন।এই ঘটনায় তাদের সহপাঠীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে এবং রাতারাতি তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে ৯ দফা দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনে দেশের প্রায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ সমর্থন দিয়েছিলো।
বিশেষঞ্জরা বলছেন, ওই আন্দোলনের পর প্রায় ৮ বছর হয়ে গেলেও এখনও বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। ঈদে তো বটেই, সারাবছরই সড়কে কোনও না কোনও দুর্ঘটনা ঘটছে।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান দুর্ঘটনা’র কিছু কারণ চিহ্নিত করেন।তিনি বলেন, দুর্ঘটনা কোনও একক কারণে হয় না। দুর্ঘটনার কারণ হিসাবে অনেকসময় দ্রুতিগতির কথা বলা হলেও বাস্তবতা হলো, দুর্ঘটনায় অনেকগুলো বিষয় নিহিত থাকে।এগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো-সড়কের গঠনে ত্রুটি থাকতে পারে, চালক অদক্ষ ও ক্লান্ত হতে পারে, যানবাহনের ফিটনেসে ঝামেলা থাকতে পারে ইত্যাদি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সেক্রেটারি মো. সাইফুল আলম মনে করেন, দুর্ঘটনার মূল কারণ অদক্ষ চালকের হাতে গাড়ি দেওয়া হয়, বিশেষ করে ঈদের সময় এমনটা বেশি হয়। তিনি বলেন, সচারাচর মহাসড়কে যে গাড়িগুলো দেখি আমরা, সারাবছর যারা চলে, তারা ওই রুটে এক্সপার্ট। প্রতিবছর ঈদের সময় দুর্ঘটনা হয়, তাই আমরা এবার ঈদে সিটি সার্ভিসের বাসগুলোকে যাত্রী নিয়ে কোথাও যেতে দেইনি। পাহারা বসাইছিলাম টার্মিনালে।
কিন্তু ফেরার পথে অনেক লোকাল বাস রিজার্ভ যাত্রী নিয়ে রওনা দেয়। রেগুলার ড্রাইভারদের আইডিয়া আছে যে পথের কোথায় বাজার, কোথায় অটো ঝামেলা করে। লোকালদের তা নাই।
তিনি এও বলেন, কক্সবাজারের ওই বাসের চালকও ওই রুটের চালক ছিল না। দোহাজারী হাইওয়ে থানার ওসি শুভ রঞ্জন চাকমাও বলেন, তারা এখন পর্যন্ত যা জানতে পেরেছেন, ঈদ উপলক্ষেই মাইক্রোবাসে ধাক্কা দেওয়া বাসটি মহাসড়কে নেমেছিলো। এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বাসটির চালকের বাড়ি বরিশাল এবং মাইক্রোবাসের চালকের বাড়ি সিলেটে।
আইনে বিচার হয় কতজনের?
যখন এই ধরনের বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন সাধারণত এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। কিছুদিন পরে আবার আলোচনা থেমেও যায় বলে জানা খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর যে হারে দুর্ঘটনা ঘটে, সেই তুলনায় বিচারের হার খুবই কম।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ নাগরিক অধিকার প্রশ্নে বিভিন্ন সময় আইনী লড়াই চালিয়েছেন। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যে মামলাগুলো হয়, সেগুলো চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় না। বেশিরভাগই কম্প্রোমাইজ হয়ে যায়। আর দুর্ঘটনার বিচার খুবই কম হয়। এক শতাংশ মামলারও চূড়ান্ত বিচার হয় না।
দুর্ঘটনা ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন তোলেন বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তার মতে, দুর্ঘটনা ঘটলে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে তা করা হয় না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ধার করা লোকজন এনে তদন্ত কমিটি করা হয়। এই বিষয়টা ত্রুটিযুক্ত। কারণ যারা সড়ক নির্মাণ করছে, যারা যানবাহনের ফিটনেস দিচ্ছে, তারাই তদন্ত কমিটিতে থাকলে তদন্ত করে দুর্ঘটনার মূল কারণ বের করা অসম্ভব।
উদাহণ হিসাবে তিনি বলেন, গাড়ির টায়ার ফেটে দুর্ঘটনা হয়েছে, প্রায়ই এমন কথা শোনা যায়। কিন্তু টায়ার পরিবর্তনের দায়িত্ব কার? মালিকের না চালকের? টায়ার কেন ফাটলো? এই টায়ারকে বিআরটিএ কীভাবে ফিটনেস দিলো?-এই প্রশ্নগুলো করা হয় না সাধারণত।
তবে কোনও সড়ক দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশে চালকরা কিছুদিনের জন্য জেল-জরিমানার মাঝে পড়ে, কিন্তু এটি স্থায়ী কোনও সমাধান নয়। পুরো সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। নইলে কোনও শাস্তিতে কাজ হবে না, বলে মনে করেন বুয়েটের এই শিক্ষক।
অন্যদিকে, যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক দায়ী করেন মামলা গ্রহণ প্রক্রিয়া, ত্রুটিপূর্ণ মামলা, জটিল তদন্ত প্রক্রিয়াকে। তিনি বলেন, আদালতের কাছে সঠিক তথ্য দিলে বিচার পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু দুর্ঘটনার মামলায় সাক্ষী পাওয়া যায় না।
এক নজরে সড়ক পরিবহন আইন :
বাংলাদেশে চালক ও পথচারী উভয়ের জন্য কঠোর বিধান যুক্ত করে ২০১৯ সাল থেকে কার্যকর করা হয়েছে বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’। ২০১৮ সালে ঢাকার দুই কলেজ শিক্ষার্থী সড়কে বাস চাপায় প্রাণ হারানোর পর শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১৯ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন পাস করে সরকার। তার ১৪ মাস পর ২০১৯ সালের পহেলা নভেম্বর থেকে সেটি কার্যকর হয়েছে।