জনসমুদ্র থেকে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৮:২১ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: ঢাকা যেন গতকাল হয়ে উঠেছিলো ‘এক টুকরো ফিলিস্তিন’। ইসরায়েলি বর্বরতা ও গণহত্যার প্রতিবাদে শ্লোগানের উন্মাতাল ঢেউ উঠেছিলো রাজধানী জুড়ে। গরমের খরতাপে পুড়ে, ঘামে ভিজে ও গলা ফাটিয়ে মানুষ উচ্চারণ করেছে- ‘তুমি কে, আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’। লাখো মানুষের সেই ঢেউ মিলিত হয়েছিলো একটি মোহনায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ঐতিহাসিক এই উদ্যান যেন একটি মুক্তিকামী ভূখ-ে পরিণত হয়ে যায়। যেখানে শ্বাস নিলো লাখো প্রতিবাদী হৃদয়। তাদের হাতে পতপত করে উড়লো লাল-সবুজ আর সাদা-কালো রঙের পতাকা- বাংলাদেশ আর ফিলিস্তিনের, প্রতিরোধের আর মুক্তির প্রতীক।
স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা এবং ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা বন্ধের দাবিতে এই ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচীর আয়োজন করে ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট’। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন সংগঠন, ইসলামি বক্তা ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ইতিমধ্যে ‘মার্চ ফর গাজা’ শীর্ষক কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
শনিবার বিকাল সোয়া ৩টায় এ কর্মসূচী শুরু হয়; সেখানে সকাল থেকেই মানুষের ঢল নামে। দুপুর ২টায় ‘মার্চ ফর গাজা’ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এর আগে সকাল থেকেই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাঁচটি পয়েন্ট দিয়ে লাখ লাখ প্রতিবাদকারী শাহবাগের উদ্দেশে আসতে থাকে।
এই কর্মসূচি ঘিরে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে ‘ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন; জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ’; ‘অ্যাকশন টু অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’; ‘ইসরায়েলের কালো হাত, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে সোহরাওয়ার্দীতে জমায়েত হয় মানুষ। এক পর্যায়ে জনারণ্য হয়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা। সমাবেশে জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেছেন, ভৌগোলিকভাবে আমরা ফিলিস্তিন থেকে অনেক দূরে হতে পারি, কিন্তু আজকের এই জনসমুদ্র প্রমাণ করে, আমাদের হৃদয়ে বাস করে একেকটা ফিলিস্তিন, আমাদের হৃদয়ে বাস করে একেকটা গাজা, আমাদের হৃদয়ে বাস করে একেকটা আল কুদস।
তিনি বলেন, আজকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, এই গণ জমায়েতে, এই জনতার গণসমুদ্রে উপস্থিত হয়ে আমরা বুঝতে পেরেছি, আজকের এই মহাসমুদ্র, জনসমুদ্র ফিলিস্তিনের প্রতি, আল আকসার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশের সব দল মত চিন্তা দর্শনের মানুষ ফিলিস্তিনিদের পাশে আছে বলে মন্তব্য করেছেন আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ইসলামিক আলোচল শায়খ আহমাদুল্লাহ।আহমাদুল্লাহ বলেন, আমরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে আজ বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে চাই, আমাদের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তা, মতগত পার্থক্য, ভিন্নতা থাকতে পারে; কিন্তু মজলুম ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা, ভূমির অধিকারের দাবিতে আমরা প্রত্যেকটা বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা প্রত্যেকে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি।
এ সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পোস্টারে জুতা নিক্ষেপ করতে দেখা যায় অনেককে। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনে জনতা ও নিরীহ শিশু হত্যার প্রতিবাদে প্রতীকি লাশ ও কফিন নিয়েও মিছিল করতে দেখা যায় অনেককে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা আবদুল মালেক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। এরপর প্যালেস্টাইন ও গাজা নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এরপর সমাবেশে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
যা বলা হলো ঘোষণাপত্রে :
ঘোষণাপত্রে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি প্রথম দাবিগুলো জানানো হয়। দাবিগুলো হলো- জায়নবাদী ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধবিরতি নয়- গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ও সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী ভূমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করতে হবে।
দ্বিতীয় দাবিগুলো জানানো হয়, মুসলিম বিশ্বের সরকার ও ওআইসির মতো মুসলিম উম্মাহর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর প্রতি। এ দাবিগুলো হলো- ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সব সম্পর্ক অবিলম্বে ছিন্ন করতে হবে। জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। গাজার মজলুম জনগণের পাশে চিকিৎসা, খাদ্য, আবাসন ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসরায়েলকে এক ঘরে করতে সক্রিয় কূটনৈতিক অভিযান শুরু করতে হবে। জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে মুসলিমদের অধিকার হরণ, বিশেষ করে ওয়াক্ফ আইনে হস্তক্ষেপের মতো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ঘোষণাপত্রে বলা হয়- ‘বাংলাদেশি পাসপোর্টে ‘এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ শর্ত পুনর্বহাল করতে হবে এবং ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার অবস্থান আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে। সরকারের ইসরায়েলি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে গাজায় ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং আমদানি নীতিতে জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনের নির্দেশনা দিতে হবে। জায়নবাদের দোসর ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের অধীনে মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে, যেহেতু হিন্দুত্ববাদ আজ শুধু একটি স্থানীয় মতবাদ নয়- বরং আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট ব্লকের অন্যতম দোসর। পাঠ্যবই ও শিক্ষানীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন এবং মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে- যাতে ভবিষ্যৎ মুসলিম প্রজন্ম নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয় নিয়ে গড়ে ওঠে।
পরে ঘোষণাপত্রে একই মাটির মানুষ, একই মুসলিম ভূখ-ের নাগরিক, একই কওমের সন্তান এবং সর্বোপরি মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে অঙ্গীকার করা হয়। অঙ্গীকারগুলো হলো- আমরা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়কট করব- প্রত্যেক সেই পণ্য, কোম্পানি ও শক্তিকে যারা ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখে। আমরা আমাদের সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করব- যারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সব প্রতীক ও নিদর্শনকে সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করবে, ইনশাআল্লাহ। আমরা আমাদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলবো- যারা নিজেদের আদর্শ ও ভূখ- রক্ষায় জান ও মালের সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত থাকবে। আমরা বিভাজিত হবো না- কারণ আমরা জানি, বিভক্ত জনগণকে দখল করতে দেরি হয় না। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব, যাতে এই বাংলাদেশ কখনো কোনো হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের পরবর্তী গাজায় পরিণত না হয়।
ঘোষণাপত্র পাঠ শেষে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও শান্তি কামনায় করা হয় বিশেষ মোনাজাত। মোনাজাত করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক। মোনাজাতে অংশ নেওয়া লাখো মানুষের চোখে ছিল অশ্রু। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা, শিশু ও নারীদের মৃত্যু, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজা উপত্যকার করুণ বাস্তবতা হৃদয়ে নিয়ে মানুষ প্রার্থণা করে শান্তির জন্য।
এই কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দেশের খ্যাতনামা আলেম-ওলামা, ইসলামিক স্কলার, খেলোয়াড়, মিডিয়া ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম সব রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সর্বস্তরের মানুষ এক কাতারে এসে ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন।
কর্মসূচির মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মুফতি ফয়জুল করিম, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব সাজিদুর রহমান, খেলাফত মজলিসের চেয়ারম্যান মাওলানা মামুনুল হক, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অন্যতম নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, নিরাপদ সড়ক চাই-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামীর সভাপতি নুরুল ইসলাম বুলবুল, সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরস মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানি, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আব্দুস সালাম, বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামিক বক্তা ও মসজিদুল জুমা কমপ্লেক্সের খতিব আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ প্রমুখ।