চৌধুরী সিন্ডিকেটে ডুবেছে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৩:১৩ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট :
অধ্যাপক ডা. মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী ও মো. নঈমুল হক চৌধুরী । সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত সমালোচিত সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ও রেজিস্ট্রার। এই দুই চৌধুরীর সিন্ডিকেটে ডুবেছে সিলেট মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় (সিমেবি)। দুর্নীতিবাজ সাবেক ভিসি, রেজিস্ট্রার ও তার সহযোগীরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে স্বাস্থ্য সেবায় সিলেটবাসীর স্বপ্নের এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ফলে প্রতিষ্ঠার ৭ বছর পরও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বিশ্ববিদ্যালয়টির।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধ্যাপক ডা. মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী ও মো. নঈমুল হক চৌধুরীর আর্থিক লোলুপ দৃষ্টির বলি সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য আর আর্থিক অনিয়মের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ ভঙ্গুর। প্রতিষ্ঠার ৭ বছর পরও স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই। এমনকি শুরু হয়নি একাডেমিক কার্যক্রমও।
কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রায় প্রধান বাঁধা অধ্যাপক ডা. মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী ও মো. নঈমুল হক চৌধুরীর সময়ে এক বছরের জন্য অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কিছু ‘ভূয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী’। ইতোমধ্যে তাদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নতুন করে পেতেছে ফাঁদ। তারা বলছেন, মোর্শেদ-নঈমুলের পাশাপাশি অবৈধদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তাহলেই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা সম্ভব।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১৮ পাস হয়। ওই বছরের নভেম্বরে প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) হিসেবে নিয়োগ পান সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী। ভিসি হিসেবে নিয়োগ লাভের পর নগরীর চৌহাট্টায় ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করেন। তখন সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে রাজস্বখাতের বিপরীতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) ১১২টি পদ অনুমোদন দেয়। সাবেক ভিসি মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার নঈমুল হক চৌধুরী ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সিন্ডিকেটের অনুমোদন ছাড়াই ২৩৯ জনকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেন। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮ এর ১২ (১০) উপ-ধারা অনুযায়ী অস্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরির মেয়াদ বহু আগেই শেষ হয়েছে। ফলে তাদের চাকরি বাতিল হয়ে গেছে। তবে গেল বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত ১০ম সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিছু জনবল নিয়োগ দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের অনুমোদন সাপেক্ষে নতুন করে কিছু জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরাই বর্তমানে বৈধ জনবল বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, ডা. মোর্শেদ ভিসি হিসেবে যোগদান করেই ওসমানী মেডিকেল কলেজের সাবেক অফিস সহকারী (গ্রেড-১৪) আব্দুস সবুরকে অ্যাডহক ভিত্তিতে অর্থ ও হিসাব দপ্তরের সহকারী পরিচালক (গ্রেড-৭) নিয়োগ দিয়ে আলোচনার জন্ম দেন। পরবর্তীতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. নঈমুল হক চৌধুরীকে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালক হিসেবে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে তিনি রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হিসেবে দায়িত্ব পান। এমনকি দায়িত্ব পেয়ে তিনি শাবিপ্রবির স্থায়ী চাকরিও ছেড়ে দেন। রেজিস্ট্রারের অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়েই কপাল খুলে যায় নঈমুল হক চৌধুরীর। তারপর পূর্বপরিচিত শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের হাফিজ গ্রুপের ক্যাডার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ভাতিজা আশরাফুল ইসলাম হিমেলকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন নঈমুল হক।
অনুসন্ধান বলছে, এই নিয়োগ সিন্ডিকেটের অপর সদস্যরা হলেন সহকারী রেজিস্ট্রার অঞ্জন দেবনাথ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা গৌতম দে, অফিস সহকারী এনি সরকার, সহকারী হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা চৌধুরী জুলফিকার খালেদ, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন, সহকারী পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) গোলাম সরোয়ার ও অফিস সহায়ক সাহেল আহমদ। এই সিন্ডিকেটই সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বাণিজ্য ও কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, প্রশাসিনক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পেয়ে আলাদীনের চেরাগ হাতে পান নঈমুল হক চৌধুরীর ঘনিষ্ট সহচর শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ভাতিজা পরিচয়দানকারী কিশোরগঞ্জের আশরাফুল ইসলাম হিমেল। অভিযোগ উঠেছে, হিমেল নিয়োগ বাণিজ্য ও আসবাবপত্র ক্রয়ের টাকা দিয়ে মাটির ঘর ভেঙ্গে গ্রামেই গড়ে তুলে আলিশান দালানকোটা। পরবর্তীতে সিলেট শহরের আখালিয়া এলাকায় জায়গা ক্রয় ও বেশ কয়েকটি সিএনজি কেনে ভাড়ায় দেন বলে সূত্র জানিয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানেও তার একাউন্টে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেনের তথ্য উঠে আসে। তিনি সৌরভ বৈষ্ণবসহ প্রায় ১৫জনকে বিপুল টাকার বিনিময়ে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছেন বলে সূত্র বলছে। অফিস সহকারী ১০ লাখ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ১৪ লাখ ও সেকশন অফিসার ১৬ লাখ টাকা করে নিয়োগের বিনিময়ে উৎকোচ নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া একটি জেনারেটর ২ লাখ টাকা দিয়ে ক্রয় করলেও সেটার বিল ৪/৫ লাখ টাকা করতেন বলেও জানান তৎকালীন কর্মকর্তারা। বিভিন্ন আসবাবপত্র ক্রয় করে সরকারি বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চতুর হিমেল।
সূত্র বলছে, সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারারের বান্ধবী খ্যাত অফিস সহকারী এনি সরকার। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের আগে ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি করতেন এনি। তিনিও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে নঈমুল হক চৌধুরীর ডান হাত আশরাফুল ইসলাম হিমেলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেন । উন্মুক্ত থেকে এইচএসসি পাস করা এনি সরকার আশরাফুল ইসলাম হিমেলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন পদোন্নতিও। কামিয়েছেন কাড়িকাড়ি টাকা। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি চলে যাওয়ার পর ফ্যাসিবাদের আমলেই আবারও তাকে ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি দেন সেই ট্রেজারার। বর্তমানে তিনি সেখানে কর্মরত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
সূত্রে জানা গেছে, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন আপন বোনের ননদকে অফিস সহকারী পদে নিয়োগ দেয়ার কথা বলে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পরবর্তীতে প্রশাসন পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় পরবর্তী ভিসি অধ্যাপক ডা. এনায়েত হোসেন মুকুল ও রেজিস্ট্রার ফজলুর রহমানের কাছে নালিশ দেন তার বোনের শ্বশুর ও শ্বাশুড়ি। কিন্তু তৎকালীন কর্তৃপক্ষ বিষয়টির দায়ভার নেবে না বলে ভিক্টিমকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন। এছাড়া অফিস সহায়ক সাহেল আহমদও বেশ কয়েকজনকে নঈমুল হকের সহায়তায় নিয়োগ দিয়েছেন। আওয়ামী ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত সাবেক অস্থায়ী সহকারী পরিচালক গোলাম সরোয়ারও কেনাকাটা করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতির টাকায় সম্প্রতি তার ছেলেকেও অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার অঞ্জণ দেবনাথ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা গৌতম দে ও দিব্য জ্যাতি সী বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ দিয়ে টাকা কামিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির তদন্ত প্রতিবদনে উঠে এসেছে, প্রতিটি নিয়োগের ভাগ পেতেন নঈমুল হক চৌধুরীও।
অপরদিকে ভিসি মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী জেবা ও শ্যালক শাহেদ গাজী মিলে আরেকটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন। সেই সিন্ডিকেট প্রায় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেয় বলে ইউজিসি ও মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে। তারাও বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে।
সূত্র অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোট ২২০ জনকে ছয় মাসের জন্য অস্থায়ীভাবে (অ্যাডহক) নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে মেয়াদ অনূর্ধ্ব ছয় মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়। নির্ধারিত সময় পূর্ণ হওয়ার পর চাকরি নিয়মিত না করে আবার অ্যাডহকে দুই থেকে পাঁচবার পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পায় ইউজিসি। অভিযোগ আমলে নিয়ে ইউজিসি ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর নিয়োগ-বাণিজ্যের বিষয়ে তদন্ত করে। তদন্তে তৎকালীন ভিসি মোর্শেদ আহমেদ চৌধুরী ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো. নঈমুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা পায়। নঈমুল হক চৌধুরী দুর্নীতির টাকায় নগরের আরামবাগ এলাকায় বেশ কয়েক শতাংশ জায়গাও ক্রয় করেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। সম্প্রতি অনিয়মের দায়ে মোর্শেদ-নঈমুলের বিরুদ্ধে দুদক মামলাও করেছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও সম্প্রতি ৫৮জনের বিরুদ্ধে দুদক আদালতে চার্জশীট দিয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার নঈমুল হক চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরীর ব্যবহৃত মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।