ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চরমে, সংঘাতের শঙ্কা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১০:৩৯ অপরাহ্ন
পানি চুক্তি স্থগিতসহ পাঁচ সিদ্ধান্ত ভারতের । আকাশপথ বন্ধসহ কড়া প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানের । আলোচনায় ভারতের ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’
জালালাবাদ রিপোর্ট : ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এলাকায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার উত্তাপ এখন ভারত-পাকিস্তানজুড়ে। কোন প্রামাণাদি ছাড়াই এ ঘটনায় ভারত পাকিস্তানের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে এবং বলছে ইসলামাবাদ ‘ক্রস-বর্ডার টেরোরিজমে’ মদদ দিচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তান এ অভিযোগ সম্পূর্ণরুপে অস্বীকার করছে। পাকিস্তান বলছে এটি ভারতের ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ বা নাটক। ভারত পাকিস্তান এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক পরিস্থিতি।
ভারত-পাকিস্তানের যেকোনো উত্তেজনার সবচেয়ে গুরুতর ঝুঁকিগুলোর একটি, উভয় দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। এ বাস্তবতা প্রতিটি সিদ্ধান্তের ওপর দীর্ঘ প্রভাব ফেলে, তা শুধু সামরিক কৌশলেই নয়; বরং রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশেও।
এরই মধ্যে পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল, পানি চুক্তি স্থগিত, সীমান্ত বন্ধসহ ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে বড় বড় পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে দিল্লি। পাশাপাশি পাঞ্জাবের অমৃতসর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে ওয়াঘা সীমান্তের প্রবেশদ্বারে পাহারা বাড়িয়েছে ভারত। এ অবস্থায় পরমাণু অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
পহেলগাম হামলা নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের ব্যাপক সন্দেহ তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা এ হামলাকে ভারতের ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ হিসেবে সন্দেহ করছেন। সাধারণত রাজনৈতিক লাভের উদ্দেশে কোনো দেশের সরকার বা গোষ্ঠী নিজেরা গোপনে অন্য আরেক দেশের বা গোষ্ঠীর নামে পরিকল্পিতভাবে এ অপারেশন চালায়।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আহমেদ সাঈদ মিনহাস বলেছেন, ভারতীয় গণমাধ্যম পাকিস্তানকে দোষারোপ করছে, অথচ হামলাটি ঘটেছে ভারতীয় অবৈধ দখলকৃত জম্মু-কাশ্মীরের ৪০০ কিলোমিটার ভেতরে। তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালে পাকিস্তান ভারতীয় পাইলট আভিনন্দনকে যথাযথভাবে ফিরিয়ে দিয়ে বড় ধরনের সহনশীলতা দেখিয়েছিল।
আরেক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) রশিদ ওয়ালি ভারতীয় মিডিয়ার উপর কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, হামলার পরপরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘বেসামরিক ও অসত্য অভিযোগ’ ছড়ানো শুরু হয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ভারত যদি আবারও কোনো ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে এর ফলাফল হতে পারে বিপর্যয়কর, যেমনটা হয়েছিল ‘বালাকোট হামলার’ পর।
যেসব সিদ্ধান্ত নিলো ভারত :
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের নেওয়া পাঁচটি পদক্ষেপ ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন শুরু করেছে দিল্লি। তারা পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য সব ধরনের ভিসা বাতিল করেছে। এর মধ্যে মেডিকেল ভিসাও রয়েছে। তাঁদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছাড়তে বলা হয়েছে। পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা কার্যক্রমও স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানে অবস্থানরত ভারতীয়দের অতি দ্রুত দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়েছে নয়াদিল্লি।
কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ২৬ ভারতীয় পর্যটক নিহত হওয়ার পর এক জরুরী বৈঠকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি পদক্ষেপ নেয় ভারত। বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পেহেলগামে হামলার প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় ভারত সরকার পাকিস্তানের নাগরিকদের ভিসা পরিষেবা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা তাৎক্ষণিক কার্যকর হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের নাগরিকদের কাছে থাকা সব ভারতীয় ভিসা আগামী রোববার (২৭ এপ্রিল) বাতিল হয়ে যাবে। পাকিস্তানি নাগরিকদের মেডিকেল ভিসার মেয়াদ থাকবে আগামী মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) পর্যন্ত।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের যেসব নাগরিক বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁদের অবশ্যই ভারত ছাড়তে হবে। এ ছাড়া ভারতের নাগরিকদের পাকিস্তান ভ্রমণ না করতে কঠোরভাবে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ভারতের যেসব নাগরিক পাকিস্তানে অবস্থান করছেন, তাঁদের অতি দ্রুত ভারতে প্রত্যাবর্তন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কড়া জবাব পাকিস্তানের :
ভারতের একতরফা প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের কড়া জবাব দিয়েছে পাকিস্তানও। বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি পদক্ষেপ নিয়েছিল ভারত। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বৈঠকে তার পাল্টায় পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সভাপতিত্বে ওই বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাঠানো বিবৃতিতে সিদ্ধান্তগুলো জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাকিস্তান কঠোরভাবে ভারতের সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা নাকচ করেছে। পাকিস্তান বলেছে, এই চুক্তি বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় হওয়া একটি বাধ্যবাধকতামূলক আন্তর্জাতিক চুক্তি, এককভাবে এই চুক্তি স্থগিতের কোনো বিধান নেই। পানি ভারতের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু, তা দেশের ২৪ কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে এবং যেকোনো মূল্যে এই পানি পাওয়ার বিষয়টি রক্ষা করা হবে। সিন্ধু চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান যে পানি পাবে, তার প্রবাহ বন্ধ বা অন্যদিকে নেওয়ার যেকোনো চেষ্টা এবং ভাটি অঞ্চলের অধিকার ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা যুদ্ধের শামিল বলে বিবেচনা করা হবে এবং জাতীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে এর জবাব দেওয়া হবে।
পাকিস্তান বলেছে, ভারতের বেপরোয়া ও দায়িত্বহীন আচরণের, যা আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তগুলো এবং আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে, পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিতের অধিকার প্রয়োগ করবে এবং তা শুধু সিমলা চুক্তি স্থগিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আর তা ভারত পাকিস্তানের ভেতরে সন্ত্রাসবাদ উসকে দেওয়া, আন্তসীমান্ত হত্যা বন্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক আইন ও কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবগুলো না মেনে চলা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
পাকিস্তান অবিলম্বে ওয়াগা সীমান্তচৌকি বন্ধ করছে। দেশটি বলেছে, এই পথ দিয়ে ভারত থেকে সব ধরনের চলাচল বন্ধ থাকবে। বৈধভাবে যাঁরা এই পথ দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা অবিলম্বে এখান দিয়ে ফেরত যেতে পারবেন। তবে ৩০ এপ্রিলের পর এ সুযোগ দেওয়া হবে না।
ভারতীয় নাগরিকদের দেওয়া সব সার্ক ভিসা বাতিল করেছে পাকিস্তান। এই ভিসার আওতায় পাকিস্তানে অবস্থানরত সব ভারতীয় নাগরিককে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশটি ছাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য শিখ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হচ্ছে না।
ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে নিযুক্ত দেশটির প্রতিরক্ষা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে পাকিস্তান। অবিলম্বে তাঁদের পাকিস্তান ছাড়তে বলা হয়েছে। তাঁদের সহায়তায় নিযুক্ত কর্মীদেরও ভারতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মকর্তার সংখ্যা ৩০-এ নামিয়ে আনতে বলেছে পাকিস্তান। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে তা করতে বলা হয়েছে। ভারতের মালিকানাধীন বা ভারত থেকে পরিচালিত সব বিমান পরিবহন সংস্থার জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান। সেই সঙ্গে পাকিস্তান দিয়ে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে ভারতের সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিতের ঘোষণাও দিয়েছে ইসলামাবাদ।
কার শক্তি কতটুকু :
ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ে কে জয়ী হতে পারে, তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা চলছে ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক শক্তি নিয়ে। দু-দেশের সামরিক বাহিনীর আকার, কার হাতে কী ধরনের অস্ত্র রয়েছে তা নিয়েও আলোচনা করছেন অনেকে।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের ২০২৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, সামরিক শক্তির নিরিখে বিশ্বের চতুর্থ সেরা দেশ এখন ভারত। আর পাকিস্তান আছে ১২ নম্বরে। ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’- সূচকে ভারতের পয়েন্ট ০.১১৮৪। দেশটির মোট সক্রিয় সৈন্য সংখ্যা ১৪ লাখ ৫৫ হাজার। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা রয়েছে এই দেশে। ভারতের মোট জনসংখ্যা ১৪০ কোটিরও বেশি। ফলে এই দেশের রিজার্ভ সেনা সংখ্যার আকারও অনেক বড়। অপরদিকে পাকিস্তনের সৈন্য সংখ্যা ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৮০০। রিজার্ভ সেনা ২ লাখ ৮২ হাজার।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ট্যাঙ্ক রয়েছে ৪ হাজার ২০১টি, পাকিস্তানের রয়েছে ২,৬২৭টি। ভারতের মোট এয়ারক্রাফট রয়েছে ২ হাজার ২২৯টি। অপরদিকে পাকিস্তানের রয়েছে ১ হাজার ৩৯৯টি। যুদ্ধবিমান ভারতের রয়েছে ৫১৩টি পাকিস্তানের ৩২৮টি। ভারতের হেলিকপ্টার রয়েছে ৮৯৯টি। পাকিস্তানের হেলিকপ্টার রয়েছে ৩৭৩টি। অ্যাটাক হেলিকপ্টার রয়েছে ভারতের ৮০টি পাকিস্তানের ৫৭টি।
বিশ্বের যেসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা বাড়াচ্ছে, সেই তালিকায় ভারত ও পাকিস্তানও আছে। গত মার্চ মাসে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্ট। যেখানে দাবি করা হয়, ভারতের ভা-ারে মজুত রয়েছে ১৮০টি পারমাণবিক অস্ত্র, আর পাকিস্তানের অস্ত্রাগারে আছে ১৭০টি।
সার্বিকভাবে বুঝা যায়, ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে আছে। তবে যুদ্ধ শুধু সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেনা, ভৌগলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, সৈনিকদের মনোবল সবকিছুই যুদ্ধ জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে সৈনিকদের মনোবল ও কৌশলগত দিক দিয়ে পাকিস্তানকেই এগিয়ে রাখছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।
তবে শক্তি যা-ই হোক না কেন ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে দুটি দেশকেই পঙ্গু করে দেবে। এমনকি আশপাশের অন্য দেশগুলোর ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়, শান্তির পথই একমাত্র সমাধান বলছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।