পাক-ভারত উত্তেজনা : মোড় নিচ্ছে কোন দিকে?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ৯:৪৭:০৫ অপরাহ্ন
পারমানবিকে এগিয়ে পাকিস্তান, সার্বিক সক্ষমতায় ভারত
জালালাবাদ রিপোর্ট: পহেলগামে হামলার পর থেকে ভারত-পাকিস্তান গত কয়েকদিন ধরে তীব্র বাকযুদ্ধে জড়িয়েছে। উভয় দেশের পাল্টাপাল্টি নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এ নিয়ে বিশ^জুড়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ অবস্থায় এখন প্রশ্ন সামনে আসছে পরিস্থিতি মোড় নিচ্ছে কোন দিকে। প্রতিবেশী দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা সাম্প্রতিক কয়েকটা শিরোনাম থেকে অনুমান করা যায়।পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি বলছে, ভারত পানি বন্ধ করলে তা যুদ্ধ বলে গণ্য হবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, প্রত্যেক নাগরিকের মৃত্যুর বদলা নেবে পাকিস্তান।
অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, হামলাকারী ও হামলার পরিকল্পনাকারীদের কল্পনাতীত সাজা দেওয়া হবে।এই পরিস্থিতি নানা অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছে।গত ২২ এপ্রিল ভারত শাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে বন্দুকবাজদের হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু হয়। মূলত পর্যটকদের নিশানা করা হয়েছিল। এই ঘটনার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে।সীমান্তের একদিকে যেমন ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের’ দাবি জোরালো হয়েছে তেমনই অন্যপ্রান্তে ‘সমুচিত জবাব’ দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প নেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো
‘উত্তেজনার সবচেয়ে বিপজ্জনক অধ্যায়’ পেরিয়ে গিয়েছে কি না?
এই প্রশ্ন ওঠার কারণ অতীতে উরি ও পুলওয়ামায় হামলার পর ভারত যে কৌশল অবলম্বন করেছিল। দুই ক্ষেত্রেই ভারত সরকারের নির্দেশে আন্তঃসীমান্ত অভিযান চালানো হয়েছিল। সেই পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।পুলওয়ামার ঘটনার পর ভারতের তরফে বালাকোটে বিমান হামলা চালানো হয়। এর প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পাকিস্তান পাল্টা পদক্ষেপ নেয়। এই আবহে যখন ভারতীয় বিমানবাহিনীর কমপক্ষে একটা বিমান ধ্বংস এবং ভারতীয় পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান, তখন দুই দেশের মধ্যে বড়সড় আকারের সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, পহেলগামে হামলার জন্য এখনও পর্যন্ত ভারত পাকিস্তানকে সরাসরি দায়ী করেনি, যেমনটা অতীতে দেখা গেছে। কিন্তু ভারত সরকার সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিত, প্রধান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করাসহ একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে, যা এই হামলার জন্য ভারত কাকে দায়ী বলে মনে করে সে বিষয়ে একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
পাশাপাশি, ভারত শাসিত কাশ্মীরের অনন্তনাগ পুলিশ এই ঘটনায় সন্দেহভাজন হামলাকারীদের স্কেচ প্রকাশ করেছে। এদের মধ্যে দু’জন পাকিস্তানি নাগরিক রয়েছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়েছে।তবে প্রমাণের অভাবে প্রথাগত ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের তরফ থেকে সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে নানারকম জল্পনা-কল্পনা চলছে। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য সেগুলোকে আরও জোরদার করছে।
এর আগে ভারতের তরফে যে সমস্ত কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে এই চলমান সংঘাত আগামী দিনে কোন দিকে মোড় নিতে পারে, তা জানার চেষ্টা করেছে বিবিসি।বিশেষজ্ঞদের কাছে জানতে চেয়েছে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার কি আরও একবার আন্তঃসীমান্ত পদক্ষেপের কৌশল গ্রহণ করতে পারে? তা যদি হয়, তাহলে তার জবাবে পাকিস্তানের তরফে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?
তবে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখে নেওয়া যাক ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সেগুলো ‘আনইউজুয়াল’ বা অস্বাভাবিক কি না।পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকের পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে সে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বারবার দাবি করেছেন, ভারতের পক্ষ থেকে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
একই সাথে তিনি এও দাবি করেছেন যে তার কাছে এমন ‘তথ্য’ রয়েছে যে “আগামী দিনে বালুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় সশস্ত্র কর্মকা- বাড়াতে ভূমিকা পালন করতে পারে ভারত।”
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জানিয়েছেন, এমনটা ঘটলে পাকিস্তান তার কড়া জবাব দেবে এবং প্রত্যেক নাগরিকের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন :
দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি ইঙ্গিত করছে যে এই সংকট এখন আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বিবিসিকে জানিয়েছেন, ভারত ও পাকিস্তান মারাত্মক সংকটের দিকে যাচ্ছে।তিনি বলেছেন, পহেলগাম হামলায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যু এবং এর জবাবে ভারতের লক্ষণীয় সিদ্ধান্ত, বিশেষত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করা প্রমাণ করে যে পরিস্থিতি আর মধ্য স্তরের উত্তেজনায় সীমিত নেই।
সাবেক মার্কিন কূটনীতিক ও থিংক ট্যাঙ্ক স্টিমসন সেন্টারের পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ থারলকেল্ড বলেন, পহেলগামে হামলার পর সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু তা কখন এবং কীভাবে হবে সেটা স্পষ্ট নয়।
তিনি বলেন, ভারতের যেকোনো হামলায় পাকিস্তান অবশ্যই জবাব দেবে এবং দুই পারমানবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে, যেখানে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দুই দেশের মধ্যে কারও কাছে পরিষ্কার নাও হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে দুই দেশ যুদ্ধের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে এমন ঘটনা নতুন নয়। গত ২৫ বছরে দেশ ভারত-পাকিস্তান বেশ কয়েকবার একেবারে যুদ্ধের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে।
২০০১ সালে সংসদে হামলার পর ভারত পাকিস্তানি বিমানের জন্য নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সীমান্তে দুই দেশই নিজেদের বাহিনী মোতায়েন করে। একইভাবে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর ব্যাপক উত্তেজনার পর সীমান্তে একই চিত্র দেখা গিয়েছিল।
এরপর ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় হামলার জবাবে ভারতীয় বিমানবাহিনী বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ভারতীয় বিমানকে নিশানা করে ভূপাতিত করে এবং বিমানচালককে আটক করে। এত কিছু সত্ত্বেও, প্রচলিত যুদ্ধ বলতে ঠিক যা বোঝায় তা দেখা যায়নি। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এবারের পার্থক্য হলো, কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি পানির মতো ‘মৌলিক’ বিষয়টাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আমির জিয়া বলেন, ভারতের তরফে অতি দ্রুত পদক্ষেপ দেখা গিয়েছে এবং আমি মনে করি তাদের (ভারতের) পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সেটা দেখার জন্য আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক পদক্ষেপ নিলে পাকিস্তান যে কড়া জবাব দেবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে একদিকে ভারতীয় নেতৃত্বের উপর জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চাপ তৈরি হচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো সেখানকার মিডিয়া ও রাজনীতি পাকিস্তানকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। অন্যদিকে ভারতের কর্মকা-ের কড়া জবাব দিতে পাকিস্তানের নেতৃত্বের উপরেও চাপ রয়েছে।
তার মতে, পাকিস্তান যদি আগামী দুই দিনের মধ্যে বিশ্বশক্তিগুলোর পক্ষ থেকে ভারতের ওপর কূটনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে সফল হয়, তাহলে তা (পাকিস্তানের কাছে) সর্বোত্তম বিকল্প হবে। এতে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হওয়া থেকেও রেহাই পাবে।
পারমানবিকে এগিয়ে পাকিস্তান, সার্বিক সক্ষমতায় ভারত :
‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার সূচক (জিএফপি) ২০২৫’-এ দেখা যাচ্ছে, পারমাণবি অস্ত্রে এগিয়ে আছে পাকিস্তান, তবে সার্বিক সক্ষমতায় এগিয়ে রয়েছে ভারত। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই পারমানবিক ক্ষমতার অধিকারী। তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলে এ সক্ষমতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের পারমানবিক অস্ত্র রয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০টি। ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে অগ্নি-থ্রি/ফাইভ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (পাল্লা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার কিলোমিটার), মিরেজ ২ হাজার ও রাফায়েল এবং সামুদ্রিক প্রতিরক্ষায় আইএনএস আরিহান্ট। পারমাণবিক অস্ত্র আগে ব্যবহার না করার (নো ফার্স্ট ইউজ/এনএফইউ) নীতির পক্ষে ভারত। তবে এ ধরনের হামলার শিকার হলে ব্যাপক আকারে প্রতিশোধমূলক হামলার পক্ষে দেশটি।
অন্যদিকে পাকিস্তানের পারমানবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৪০ থেকে ১৫০। এদিক থেকে পাকিস্তানের সক্ষমতা ভারতের চেয়ে বেশি। ডেলিভারি সিস্টেমের মধ্যে আছে শাহিন-টু/থ্রি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাত্র, এফ-১৬ যুদ্ধবিমান, বাবর ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশটি ‘ফুল-স্পেকট্রাম ডেটারেন্স’ নীতি অনুসরণের পক্ষপাতী। এ নীতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে দেশটি প্রয়োজনে আগেভাগে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।