ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠক : সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের মেয়াদে জামায়াতের দ্বিমত
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:০০:৩৭ অপরাহ্ন
♦ ১ ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয় ♦ এমপিরাও দলের বিপক্ষে মত দিতে পারবেন ♦ সংসদ হবে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট ♦ দ্রুততম সময়ে জাতীয় সনদ চায় কমিশন
জালালাবাদ রিপোর্ট: জাতীয় সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ অপরিবর্তিত রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চার বছর মেয়াদের প্রস্তাব দিলেও জামায়াত চায়, এই মেয়াদ ৫ বছরই থাকুক। তবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। একই ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয় প্রস্তাবেও একমত দলটি। এছাড়া আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা পূনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে ঐকমত্য কমিশনের সাথে দৈনব্যাপী বৈঠকে এ মতামত তুলে ধরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সকাল থেকে আলোচনা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। চলে দিনব্যাপী। অসমাপ্ত আলোচনা আরেকদিন চলবে বলে জানা গেছে।
গতকালের বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে কমিশনের সাথে একমত হয়েছে জামায়াত। সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে আর্টিকেল ৭০-এর ক্ষেত্রে কিছু সংশোধন সহকারে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত। সংবিধান পরিবর্তন, অর্থবিল বা বাজেট অনুমোদনের ক্ষেত্রে এবং আস্থা ভোট- এই তিনটি বিষয় ছাড়া যেকোনো বিষয়ে একজন সংসদ সদস্য দলের মত ও অবস্থানের বিপরীতে ভূমিকা রাখতে পারবেন।
ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিলের ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত। আরও বিস্তারিত আলোচনা দরকার। এটি গঠনের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে কমিটিতে না রাখতে বলা হয়েছে।
আনুপাতিক হার (পিআর) সিস্টেমে নির্বাচনের কথা বলেছেন জানিয়ে জামায়াত বলেছে, এটা হলে নির্বাচনে দুর্নীতি, জবরদখল, ভোটবিহীন নির্বাচন ও টাকার খেলা বন্ধ হবে। বিশ্বের ৬০টির মতো দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে একমত প্রকাশ করা হয়েছে।
সংবিধানের ওপরও আলোচনা হয়েছে, তবে সংবিধান সংশোধন কীভাবে হবে, এ বিষয়ে পরে আলোচনা হবে। নারী আসন বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা এখনো হয়নি, কিছু আলোচনা হয়েছে। এছাড়া বহুত্ববাদকে পুরো বাদ দিতে বলেছে দলটি। প্রস্তাব করেছে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য।
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ এবং রাষ্ট্রপতির মেয়াদ কমিয়ে চার বছর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু জামায়াত বলেছে, এটি যৌক্তিক হবে না। দিনশেষে জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ১০ জনের একটি সমন্বয় কমিটি এসেছি। সোয়া ৫টা পর্যন্ত আলোচনা করেছি। আলোচনা অসমাপ্ত আছে, আবার বসা হবে। তিনি বলেন, বেশি তাড়াহুড়ো করছি না। উল্লেখযোগ্য সংস্কারের লক্ষ্য অর্জন করতে চাচ্ছি। কমিশনেরও লক্ষ্য জাতির জন্য প্রয়োজনীয় এবং অতিগুরুত্বপূর্ণ সংস্কারে পৌঁছানো।
ক্রেডিবল ও সাসটেইনেবল গণতন্ত্র চায় জামায়াত :
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশে একটি স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় বলে জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। ডা: তাহের বলেন, আমরা এমন নির্বাচন চাই, যেটিকে দেশের মানুষ, সারাবিশ্ব নির্বাচন বলবে। আজকে আমাদের বড় ক্রাইসিসের কারণ গত তিন টার্ম যে নির্বাচন হয়েছে তা কোনো নির্বাচন ছিল না। নির্বাচন ছাড়া যাতে ক্ষমতায় থাকা যায় তার জন্য যা যা করার তাই করা হয়েছিল। জবাবদিহিতা ছিল না। তার পরিণতি তারা আমরা সমগ্র জাতি ভোগ করছি। আমরা এটার পুনরাবৃত্তি চাই না।
ডা. তাহের বলেন, যেখানে যেখানে নতুন কিছু সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজন আছে, যা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর, সেখানে আমরা ব্যক্তি, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি বা স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে চাই না, দেবও না। এর ঊর্ধ্বে থেকে দেশ জাতি ও মানুষের কল্যাণের জন্য যেটা প্রয়োজন জামায়াতে ইসলামী সেই কাজে সংস্কারে, পরিবর্তনে পরিপূর্ণ একমত পোষণ করে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কতিপয় ব্যাপারে খুবই দৃঢ় ও অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রথমত হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এজন্য আমরা কোনো রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে ভয় করি না। স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা কারও হস্তক্ষেপ স্বীকার করি না। দ্বিতীয়ত, ক্রেডিবল ও সাসটেইনেবল গণতন্ত্রের জন্য জামায়াতে ইসলামী অঙ্গীকারবদ্ধ।
ডা. তাহের বলেন, আমরা শুরু রাষ্ট্রের ভেতরে নয়, দলের ভেতরেও আমরা এই গণতান্ত্রিক চর্চা করি। আমাদের দলীয় নির্বাচন সময় মতো হয়। ক্যাম্পেইন ছাড়া, প্রার্থী ছাড়া, প্যানেল ছাড়া অপেন ব্যালটে আমাদের দলীয় নির্বাচন হয়। আমরা বলি এটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য যে, নো ক্যাম্পেইন, নো ক্যান্ডিডেট, নো প্যানেল। এ ধরনের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের চর্চা আমরা দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি।
দ্রুততম সময়ে জাতীয় সনদ চায় কমিশন :
আলোচনার সূচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এমন একটি বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চাই, যাতে মানুষ আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার না হন।
আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বীর শহীদদের আত্মত্যাগে আমরা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের এই বীর শহীদদের কাছে ঋণ আছে। যে সুযোগ ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগে তৈরি হয়েছে, তা যেন লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হয়।’
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করার কথা উল্লেখ করে আলী রীয়াজ আরও বলেন, আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি জাতীয় সনদে উপনীত হতে চাই। আলী রীয়াজ আরও বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের তাগিদ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এসেছে, ছাত্রসমাজের কাছ থেকে এসেছে এবং সর্বোপরি দেশের সকল স্তরের মানুষের কাছ থেকে এসেছে।
আলী রীয়াজ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জামায়াতের লড়াইয়ের প্রশংসা করেন। তিনি নেতৃবৃন্দকে বলেন, আপনাদের কর্মীরা, নেতৃবৃন্দ নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, অত্যাচার সহ্য করেছেন। এরপরও আপনারা সাহসিকতার সঙ্গে তা মোকাবেলা করেছেন, সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন-সেজন্য আপনাদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আপনাদের অবদান নিঃসন্দেহে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমরা আশা করি, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পথচলায় আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
আলী রীয়াজ স্মরণ করিয়ে দেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় জামায়াত নেতাকর্মীরা সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন, কেউ কেউ প্রাণও দিয়েছেন, অনেকে কারাগারে থেকেও আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে আলোচনায় অংশ নেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, সাবেক বিচারপতি এমদাদুল হক ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে আলোচনায় অংশ নেন রাজনৈতিক দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, জামায়াতের আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনির। প্যানেল সদস্য হিসেবে ছিলেন মহিউদ্দিন সরকার।