আলোচনায় করিডোর ও স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৯:২০ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ‘একটি হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বা মানবিক করিডরের’ বিষয়ে নীতিগত সম্মতির কথা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এমন সিদ্ধান্ত কারা, কোথায়, কোন প্রক্রিয়ায় এবং কিসের ভিত্তিতে নিচ্ছে, সেই আলোচনা উঠছে। ওদিকে, জামায়াতে ইসলামী চীনের কাছে একটি স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্রের প্রস্তাব তুলেছে। সেটি নিয়েও আলোচনা চলছে রাজনীতিতে।
বিশ্লেষকদের মতে, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া এবং একই সাথে মিয়ানমারে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মি ছাড়াও মিয়ানমারে প্রভাব আছে- এমন আঞ্চলিক সব পক্ষ একমত না হলে প্রস্তাবিত করিডরটি বাংলাদেশের জন্য সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলো মানবিক করিডরের জন্য বাংলাদেশের বিকল্প হিসেবে মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দর ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার উপকূলের অনেক জায়গাই ব্যবহার করতে পারে।
আবার রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার ইস্যু নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে কাজ করছেন, এমন গবেষক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বিষয়ে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে, এমনকি রোহিঙ্গা ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে কোনো আলোচনা হয়েছে- এমন কোনো ইঙ্গিত তারা পাননি।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ অবশ্য বলছেন, প্রস্তাবিত মানবিক করিডরের ব্যবস্থাপনা জাতিসংঘের হাতে থাকলেও এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতেই থাকতে হবে, যাতে করে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ নিজেই তা বন্ধ করে দিতে পারে। অন্যথায় বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে না এমন কিছুও সেখানে ঘটে যেতে পারে ।
এদিকে মানবিক করিডর নিয়ে এমন আলোচনার মধ্যেই ঢাকায় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির একটি দলের সাথে আলোচনায় শনিবার বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল রোহিঙ্গাদের জন্য ‘স্বাধীন আরাকান’- প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব তুলে ধরেছে বলে জানা গেছে।
মিয়ানমারের পরিস্থিতি ও করিডর নিয়ে সরকার যা বলেছে :
মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশটির রাজধানী এখনো সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পাশাপাশি আরাকান আর্মির অস্ত্রসহ অন্য রসদ সরবরাহের পথও জান্তা বাহিনী বন্ধ করে রেখেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।গত বছর ১১ ডিসেম্বর খবর আসে যে আরাকান আর্মি মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই প্রথম মিয়ানমারের পুরো একটি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলো কোন বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
এমন পরিস্থিতিতে তখন বিভিন্ন মহল থেকে আরাকান আর্মির সাথে সরকারের যোগাযোগ করার প্রসঙ্গটি আলোচনায় উঠে আসে। তার আগে গত নভেম্বরেই জাতিসংঘ রাখাইনে মানবিক সংকট তীব্র হওয়ার খবর দিয়েছিলো। পরিস্থিতিকে দুর্ভিক্ষের মতো উল্লেখ করে আরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতাতেই পরে মানবিক করিডরের বিষয়টি পর্দার আড়ালের আলোচনায় উঠে আসে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন রবিবার মন্ত্রণালয়ের সাংবাদিকদের জানান, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডর) একটা হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।কিন্তু জাতিসংঘের প্রস্তাবে কী বলা হয়েছে, শর্ত হিসেবে বাংলাদেশ কী চেয়েছে কিংবা সেই একই করিডর দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার সুযোগ থাকবে কি-না এসব কিছুই সরকার প্রকাশ করেনি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলছেন, সরকার নীতিগত রাজি হয়ে ভালো করেছে কারণ যেই করিডর দিয়ে সহায়তা যাবে সেই একই করিডর দিয়ে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠিয়ে তাদের জন্য সেখানেই মানবিক সহায়তার কথা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলতে পারবে।
তিনি বলছেন, করিডর জাতিসংঘ করলেও এতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত কিংবা এমন আরও কোনো শক্তি যুক্ত আছে কি-না সেটা জানতে হবে এবং তারা কিসের ভিত্তিতে যুক্ত হবে সেটাও সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে। মনে রাখতে হবে এটা করতে গিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে যেন নতুন সংকট তৈরি না হয়।
আলোচনাটি এলো কীভাবে :
আরাকান বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর গত বছর ১৪ই ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শিরোনামের একটি আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি দেয়া বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগের একটি ধারণা দিয়েছিলেন।
ওই আলোচনা সভাতেই সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমান মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য করা ও মানবিক করিডর খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এর পর মার্চের শুরুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাখাইনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মির মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে মন্তব্য করে।
এর কয়েকদিন পরেই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ঢাকায় আসেন ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। তখন রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য একটি করিডর চালু করতে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ। ৮ এপ্রিল ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে খলিলুর রহমান মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প না থাকার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র চ্যানেল, যার মাধ্যমে এটা করা সম্ভব। কারণ, রাখাইনের উপকূল এখনও তাতমাদোর (জান্তা বাহিনী) দখলে এবং অন্যান্য জায়গা দিয়ে সহজে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব নয়।
তিনি তখন জানিয়েছিলেন যে, মানবিক চ্যানেল (প্রস্তাবিত করিডর) তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মিকে জাতিসংঘই আলোচনায় বসাচ্ছে আর আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনায় জাতিসংঘকে মাঝামাঝি রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
কেমন প্রভাব পড়তে পারে ভবিষ্যতে :
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষকদের কেউ কেউ বলেছেন, বিশ্বে যুদ্ধ চলমান যেসব জায়গায় মানবিক করিডর করা হয়েছে, সেগুলোকে শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র মানবিক করিডরে সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি, বরং এর সঙ্গে সামরিক নানা বিষয় যুক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশ এখন রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য করিডর দিলেও তাতে আদৌ রাখাইনের বেসামরিক নাগরিকদের লাভ হবে কি-না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ আরাকান আর্মির রসদ সরবরাহের অন্য পথ বন্ধ করে রেখেছে জান্তা সরকার।
ফলে বাংলাদেশের করিডর দিয়ে যাওয়া সহায়তা আরাকান আর্মির হাতেই থাকে কি-না তা নিয়েও কৌতূহল থাকবে। আবার আরাকান আর্মির হাতেও রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে আরও এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
মিয়ানমার বিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ বলছেন, মানবিক করিডরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত হচ্ছে অথচ দেশের মানুষ, রাজনীতিক ও প্রশাসনের কেউ কিছু জানে না বলেই তারা তথ্য পাচ্ছেন।
স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্রের প্রস্তাব চীনের কাছে :
রবিবার ঢাকা সফররত চায়নার কমিউনিস্ট পার্টির সাউথ এশিয়া রিজিওনের ডিরেক্টর জেনারেল পেং জিউবিন এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছে জামায়াতে ইসলামী।ওই বৈঠকে দলটির নেতারা আরাকান কেন্দ্রিক রোহিঙ্গাদের যে মেজরিটি আছে, সে এরিয়াতে একটি ইন্ডিপেনডেন্ট আরাকান স্টেট করার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে দলের এক বিজ্ঞ্তিতে বলা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহেরকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘চায়না এখানে সবচাইতে বেশি ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ মিয়ানমারের সাথে চায়নার বড় ধরনের রিলেশনশিপ আছে। তারা আমাদের এই নিউ প্রোপোজাল সম্পর্কে তাদের গভর্নমেন্টকে বলবে এবং উদ্যোগ গ্রহণ করার ব্যাপারে তারা চেষ্টা করবে।