ধরা ছোঁয়ার বাইরে লোপাটের মূল হোতারা
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ৭:২০:৫৩ অপরাহ্ন
আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া: মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে কথা উঠলেই চলে আসে শ্রমিক নির্যাতন ও সিন্ডিকেশনের চিত্র। দেশটির শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্য বারবার বন্ধ হওয়ার পিছনে শুধু শ্রমিক নির্যাতন ও সিন্ডিকেশন নয়, বৃত্তের বামফরে রয়েছে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। গত ৫ আগস্টের ছাত্র জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে বিগত সরকারের পতনের পরও মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ২৪ হাজার কোটি টাকা লোপাটের মামলা হলেও মূল হোতারা এখনো রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই সিন্ডিকেটের মূল হাতিয়ার ছিলো মালয়েশিয়ার কর্মী নিয়োগের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এফডব্লিউসিএমএস।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই সিস্টেমটিকে ব্যবহার করে রুহুল আমিন স্বপন ও দাতুশ্রী আমিন কর্মী নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। যদিও এফডব্লিউসিএমএস মূলত মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে বিদেশি কর্মী নিয়োগের অনলাইন সাপোর্ট দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ একটি কোম্পানি। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, একই পদ্ধতিতে মালয়েশিয়া আরও ১৪টি দেশ থেকে কর্মী নিলেও শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা সীমিত করে সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সিন্ডিকেটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য রুহুল আমিন স্বপন ও দাতুশ্রী আমিন প্রতিটি রিক্রুটিং এজেন্সির কাছ থেকে প্রথমে ৫ কোটি টাকা করে নিয়েছেন, যা পরবর্তীতে ১৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা।
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বরাবর সোচ্চার ও ২৪ হাজার কোটি টাকা লোপাটের বিরুদ্ধে মামলাকারী রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স আফিয়া ওভারসিস (আর এল-১০১০) এর সত্ত্বাধিকারী আলতাব খান বর্তমানে কারা সিন্ডিকেট করার পাঁয়তারা করছেন এ মর্মে তিনি বলেন, রুহুল আমিন স্বপন, দাতোশ্রী আমিন, মোঃ নুর আলী, ওয়ান ইলেভেন এর হোতা জেনারেল (অব:) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও নিজাম হাজারী গং পূর্বের কায়দায় আওয়ামীলীগের পলাতক বিভিন্ন নেতা যারা মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত তারা সহ বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কিছু নেতাকে সম্পৃক্ত করে সিন্ডিকেট করার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সরকারকে বুঝানোর চেষ্টা করছে সিন্ডিকেট ছাড়া মালয়েশিয়া কর্মী নেবে না, যা মোটেই সত্য নয় বরং তারাই বিভিন্নভাবে নির্বিঘেœ কর্মী প্রেরণের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন। তিনি আরো বলেন, রুহুল আমিন স্বপন, দাতোশ্রী আমিন, মোঃ নুর আলী, ওয়ান ইলেভেন এর অন্যতম হোতা জেনারেল (অব:) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও নিজাম হাজারী গং একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্র। তারা দেশের উন্নয়নের অংশিদার প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশে চাকরি দেয়ার জন্য সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট মাফিয়া চক্র গড়ে তুলে বিদেশগামী শ্রমিকদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার স্থলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ দেশে ও বিদেশে গড়ে তুলেছেন। সরকার স্বীকৃত দুই হাজারের অধিক রিক্রুটিং এজেন্ট থাকা সত্বেও এ মাফিয়া সিন্ডিকেট চক্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে জঘন্য অপরাধ করেছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গা গেলে মালয়েশিয়াতে মাত্র দেড় লাখ টাকায় শ্রমিক পাঠানো সম্ভব বলে জানিয়েছে বায়রার একটি প্রতিনিধি দল।
ব্যবসায়ী হারুন-উর-রশিদ বলছেন, যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে একজন শ্রমিক পাঠানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু সিন্ডিকেট নিয়ে গত এক দশক ধরে এত বড় কেলেঙ্কারি হবার পরও এখনো সেটা ভাঙ্গা সম্ভব হয়নি। যখনই মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর সম্ভাবনা দেখা দেয়, চুক্তি হয়, তখনই ওই সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়।
বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির তালিকায় চতুর্থ দেশ হিসেবে রয়েছে মালয়েশিয়া। কিন্তু এরপরও এ দেশের শ্রমবাজার নিয়ে বিভিন্ন সময় নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন সময় দফায় দফায় বন্ধ হয়ে যায় সেখানকার বাংলাদেশের শ্রমবাজার। সর্বশেষ গত বছরের জুন থেকে আবারো বন্ধ হয় সেদেশে বাংলাদেশসহ সব দেশের শ্রমবাজার। ১৯৭৮ সালে প্রথম মাত্র ২৩ জন শ্রমিক মালয়েশিয়া যায়। বাংলাদেশের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ওয়েবসাইটে এ তথ্য পাওয়া যায়। তবে, বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সাথে জড়িত ব্যক্তি, জনশক্তি রপ্তানি বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের সাথে জনশক্তি নিয়োগের চুক্তি হয় ১৯৯২ সালে।
শ্রমবাজারের যাত্রা শুরুর পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২০টিরও বেশি দেশের পরিসংখ্যান এই ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। ওয়েবসাইটের তথ্য মতে ৪র্থ অবস্থানে রয়েছে মালয়েশিয়া। সেখানে এ পর্যন্ত শ্রমিক গিয়েছে ১৪ লাখেরও বেশি। মালয়েশিয়াতে রয়েছে বাংলাদেশের নয় শতাংশের বেশি শ্রমবাজার।
বিএমইটির ওয়েবসাইটে যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম ২৩ জন শ্রমিক মালয়েশিয়াতে যায়। পরের বছর কোন শ্রমিক মালয়েশিয়াতে না গেলেও ১৯৮০ সালে মাত্র তিনজন শ্রমিক সে দেশে যায়। এরপরের দুই বছর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যায়নি কোন বাংলাদেশি। দুই বছর বাদে আবার ১৯৮৩ সালে ২৩ জন মালয়েশিয়াতে যায়। এরপরে দুই বছর আবার কোন শ্রমিক যায়নি এই দেশটিতে। কিন্তু ১৯৮৬ সালে সর্বোচ্চ ৫৩০ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যায়।
এই ওয়েবসাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের বাংলাদেশিদের যাতায়াত চলে। তবে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এই দেশের বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের যাত্রা বৃদ্ধি পায়।
২০০৮ সালে বন্ধ হওয়া শ্রমবাজার দীর্ঘ আট বছর পর চালু হয়েছিল ২০১৬ সালে। এরপর দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের অভিযোগে ফের ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নতুন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে সেই বাজার খুলতে সময় লেগেছিল আরো তিন বছর। ২০২২ সালের আগস্টে দেশটিতে আবারও বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হয়। সে হিসেব ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই ৮ বছরে মালয়েশিয়া আসে প্রায় ৮ লাখ ১১ হাজার ৮৪৫ জন কর্মী। মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ১ জুন থেকে বাংলাদেশসহ বিদেশি কর্মীদের দেশটিতে প্রবেশ বন্ধ থাকায় আঠারো হাজার বাংলাদেশি কর্মীর ভাগ্যে কবে যে শিকে ছিড়বে তা কে জানে?
নাম না প্রকাশ করার শর্তে মালয়েশিয়াস্থ কয়েককটি কোম্পানীর মালিক ও কূটনৈতিক সূত্র বলছে, চলতি বছরের জুনের আগে পরে খুলতে পারে মলেয়শিয়ার শ্রমবাজার। সে হিসেবে সাবেক সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট করে হাজার কোটি টাকা লোপাটকারী সিন্ডিকেটের মূল হোতারা আবারো হয়ে উঠেছে সক্রিয়। যার প্রমাণ মেলে গত ৭ এপ্রিল ২০২৫ দেশটির ফ্রি মালয়েশিয়া টুডেতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। সেখানে পত্রিকাটি অভিবাসী অধিকারকর্মী অ্যান্ডি হলের উদৃতি দিয়ে বলেছে, মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ২০২১ সালের চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। তার দাবি, ‘চুক্তির যেসব ধারা সিন্ডিকেটদের পক্ষে সুযোগ তৈরি করেছে, সেগুলো বাতিল না করলে এই অনিয়ম কখনোই বন্ধ হবে না।”
২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮ লক্ষ ১১ হাজার ৮৪৫ জন বাংলাদেশি কর্মী এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় এসেছেন এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে ১ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করেছে এই সিন্ডিকেট চক্রটি। যার গুণফল দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকারও বেশি। এই একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারা সিন্ডিকেটটির ফলে অভিবাসন খরচ আকাশচুম্বী হওয়ায় বহু সাধারণ মানুষ হয়েছে সর্বস্বান্ত। শুধু তাই নয়, প্রায় ২ হাজার ৫ শত বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি এজেন্সি সিন্ডিকেটের অন্তর্ভুক্ত থাকায় অন্যরা কর্মী পাঠানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সুযোগ হয়েছে, তেমন বারবার বন্ধ হয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
বার বার কেন এ সিন্ডিকেট গড়ে উঠছে এ প্রশ্নের জবাবে, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি বায়রার ১নং সদ্য-সাবেক জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল ও হিউমান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আরএল নং-৪৫২) এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম এক অডিও বার্তায় জানিয়েছেন, মালয়েশিয়ার শ্রম বাজারে বারবার সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছিল এবং বারবার শ্রমিক বাজার বন্ধ হয়েছিল। বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপনের নেতৃত্বে সাবেক সরকারের মন্ত্রী, এমপিরা এবং নেতারা এই সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিল এবং এই সিন্ডিকেট চক্র বাংলাদেশ থেকে যত কর্মী মালয়েশিযাতে গিয়েছে প্রত্যেক কর্মী থেকে ১ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা করে অতিরিক্ত চাঁদা নিয়েছে। তার মানে এই দুবারে প্রায় ৮ লক্ষ ১১ হাজার শ্রমিক গিয়েছে এবং প্রত্যেক কর্মী ১ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা করে বাধ্যতামূলকভাবে অতিরিক্ত তাদেরকে দিয়েছে। সে হিসেবে এ সিন্ডিকেটটি প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা এখান থেকে জালিয়তি করেছে। যেখানে সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং আমলারা ছিল এবং যেখানে সাবেক সরকারের নেতারা এই সেক্টরের ৯৫% সদস্যকে বঞ্চিত করেছে, কর্মীদেরকে বিভিন্নভাবে প্রতারিত করেছে এবং অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ নিয়েছে। সেই একই সিন্ডিকেট কি আবারও হবে? এটা আমরা মনে করি এই সিন্ডিকেট যদি হয় এই সরকারকে সুনামক্ষুন্ন করার জন্য, সরকারকে বিব্রত করার জন্য এই সিন্ডিকেট চক্র এই একইভাবে আবার সিন্ডিকেট করার অপচেষ্টা করছে। আসলে তাদের বিচার না হওয়ার কারণেই তারা বারবার সিন্ডিকেট করার অপচেষ্টা করছে বলে বলছিলেন ফখরুল।