পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা : কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশ-ভারতে?
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ মে ২০২৫, ৮:২৬:৩৪ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর সম্ভাব্য প্রভাবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন দেশ দুটির ব্যবসায়ীরা। কী প্রভাব পড়বে সে নিয়েও বিশ্লেষণ চলছে নানাভাবে। এ নিয়ে প্রতিবেদন করেছে বিবিসি।দেশীয় শিল্পকে সস্তা আমদানির চক্র থেকে বের করে আনতে গত মাসে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে স্থলপথে তুলা আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
মূলত ভারত হঠাৎ করেই বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা স্থগিত করার পরপর-ই ঢাকার তরফ থেকে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।আগে ওই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ভারতের সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারত। কিন্তু ভারত কনজেশন বা পণ্যের তীব্র জট তৈরি হচ্ছে-এই অজুহাত দেখিয়ে ওই সিদ্ধান্ত নেয়।
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ অগাস্ট বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষ্মতাচ্যুতির পর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে।ক্ষমতা হারিয়ে বর্তমানে তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন এবং বাংলাদেশ পরিচালনা করছে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থপাচার ও দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ আছে। এগুলোর বিচারের জন্যই দিল্লির কাছে বারবার শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণ দাবি করেছে ঢাকা। তবে দিল্লিও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।
এদিকে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ব্যাপারে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, ওগুলোর বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে সমালোচনা করেছে ভারত।তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ ওইসব অভিযোগ নাকচ করে বলেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের ঘটনাগুলো হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। পোশাক শিল্পের জন্য তুলা বাংলাদেশের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত থেকে এখনো বাংলাদেশে তুলা আসছে, তবে তা কেবল সমুদ্রপথে বা আকাশপথে-যা স্থলপথের তুলনায় অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। ২০২৪ সালে ভারত বাংলাদেশে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের তুলা রপ্তানি করেছিলো, যার এক-তৃতীয়াংশ এসেছিলো স্থলবন্দর দিয়ে।
এদিকে, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের নামী-দামী ব্র্যান্ডগুলোর জন্য পোশাক রপ্তানি করা হয়। কিন্তু এতদিন ওইসব পোশাকের একটি বড় অংশ প্রথমে সড়কপথে ভারতে প্রবেশ করতো। তারপর ওগুলো ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আওতায় ইউরোপ ও আমেরিকায় পাঠানো হতো।
ইউরোপের বিভিন্ন ব্র্যান্ডকে তৈরি পোশাক সরবরাহকারী এমজিএইচ গ্রুপের প্রধান আনিস আহমেদ বলেন, ফাস্ট ফ্যাশন রপ্তানিতে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিশাল ধাক্কা। ভারতের ওই রুট ধরে মালামাল ইউরোপ-আমেরিকায় পৌঁছাতে এক সপ্তাহের মতো সময় লাগতো। কিন্তু এখন সমুদ্রপথে তা পাঠাতে আট সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। তিনি জানান, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করা হয়েছে। এর মাঝে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে ভারতের বন্দর ব্যবহার করে।
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, কিছুদিন আগে চীন সফরে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কিছু মন্তব্যই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের অন্যতম কারণ। তিনি বলেছিলেন যে এই অঞ্চল চীনা অর্থনীতির সম্প্রসারণ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেতারা মুহাম্মদ ইউনূসের ওই মন্তব্যকে ‘আপত্তিকর’ বলেছেন।
চীনের সাথে ভারতের সীমান্ত নিয়ে যে টানাপোড়েন আছে, মুহাম্মদ ইউনূসের এ মন্তব্যের মাঝ দিয়ে তা ফুটে উঠেছে এবং এ পুরো বিষয়টি দিল্লিকে উদ্বেগে ফেলেছে। ভারতের মূল ভূখ- থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে সংযুক্ত করার একমাত্র উপায় শিলিগুড়ি করিডোর, ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত এবং এই করিডোর মাত্র ২০ কিলোমিটার প্রশস্ত।এছাড়া নেপাল ও বাংলাদেশ দিয়ে ঘেরা এই করিডোরটির অবস্থান তিব্বতের চুম্বি উপত্যকার কাছাকাছি। এদিকে, তিব্বত হলো এমন এক অঞ্চল, যা চীনের শাসনাধীন। এই শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেনস নেকের নিরাপত্তা নিয়ে বহুদিন ধরেই উদ্বেগে দিল্লি।
চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনার ইতিহাস ও ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে ভারতের প্রতিরক্ষা খাতের পরিকল্পনাকারীদের আশঙ্কা- চীন যদি কখনো কোনো সংঘাতের জেরে এই করিডোর বন্ধ করে দেয়, তাহলে ভারত থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হতে পারে।
বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাদের মতে, তার বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল, এই অঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্কের উন্নয়ন।প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরকালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এক বিলিয়ন ডলারের তিস্তা নদী প্রকল্পে চীনের আগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছে ঢাকা।
ভারতীয় বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, চীন যদি শিলিগুড়ি করিডোরের কাছাকাছি অবস্থিত ওই প্রকল্পে যুক্ত হয়, তাহলে তা দিল্লিকে অস্থির করে তুলতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে সম্পর্কের অবনতির কারণে একপ্রকার উদ্বেগ রয়েই যাচ্ছে।
বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কড়াকড়ি করেছে ভারত। বিশেষ করে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর খুবই কম মানুষকে ভিসা দেওয়া হচ্ছে।আগে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ বাংলাদেশি ভারতে যেতেন। কেউ চিকিৎসার উদ্দেশ্যে, কেউ কেউ আবার শিক্ষা, ব্যবসা ও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তখন ভারতে যেতেন। অথচ আগের তুলনায় ভিসা অনুমোদনের হার ৮০ শতাংশের বেশি কমে গেছে এখন।
শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয়গ্রহণ এবং তাকে বাংলাদেশে ফেরানোর দাবি নিয়েও দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে একপ্রকার অস্থিরতা তৈরি হয়ে আছে।এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারীদের সংগঠন স্থলপথে বাংলাদেশের পোশাক আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশি বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বাস্তবায়ন করা হলে উভয় দেশেরই ক্ষতি হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এখন বাংলাদেশেও একটি দৃঢ় মতামত গড়ে উঠেছে যে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে শেখ হাসিনা সরকার যে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিয়েছিলো, ওটিকে পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। ভারত তার স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন করার জন্য বাংলাদেশের বন্দর, সড়ক ও নদীপথ ব্যবহার করে। এতে ভারতের খরচ ও সময় দুই-ই বাঁচে।
এদিকে, সরকার পরিবর্তনের পর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হলেও এই সময়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ক্রমশ বাড়ছে। শেখ হাসিনা তার ১৫ বছরের শাসনামলে পাকিস্তানের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। তবে সম্প্রতি ১৫ বছর পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ ঢাকায় সফর করেন। এরপর পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারেরও বাংলাদেশে সফরের কথা ছিল।
কিন্তু গত সপ্তাহে ভারতনিয়ন্ত্রত কাশ্মীরে এক হামলার ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক আরও খারাপ হওয়ার কারণে ওই পরিকল্পিত সফরটি স্থগিত করা হয়েছে।বাংলাদেশে এখন ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে। অন্যদিকে, ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অতিরঞ্জিত করার অভিযোগ রয়েছে। এই দুই প্রতিবেশী দেশের মাঝে গড়ে ওঠা দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এখন তলানির দিকে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, উভয় দেশ ধৈর্য না ধরলে তাদের বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতি হতে পারে।