চালু হবে কী শমসেরনগর বিমানবন্দর
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ মে ২০২৫, ১২:১০:৫৭ অপরাহ্ন
তামিম মজিদ : কয়েক দশক ধরে আশ্বাসেই আটকে আছে মৌলভীবাজারের শমসেরনগর বিমানবন্দর চালুর প্রক্রিয়া। আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে তিন মন্ত্রী বিমানবন্দরটি চালুর ঘোষণা দিলেও সেই ঘোষণা আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ ছিল, বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে বিমানবন্দরটি চালু নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাম্প্রতিক উদ্যোগও আশ্বাস হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলাবাসী বলছেন, বিমানবন্দর চালুর আশ্বাস বহুবার দিলেও বাস্তবায়ন এখনও শূন্য। ফলে আদৌ এবারও কী চালু হবে শমসেরনগর বিমানবন্দর ? নাকি আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবারের উদ্যোগ, এমন প্রশ্ন তাদের।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পর্যটক মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ঘুরতে আসেন। ফলে বিমানবন্দরটি চালু হলে সরকারের রাজস্ব যেমন বাড়বে, তেমনই জেলার পর্যটন শিল্পও বিকশিত হবে। ফলে শমসেরনগর বিমানবন্দর চালু সময়ের দাবি।
অ্যাভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ জেলায় অনেকগুলো আন্তর্জাতিক মানের রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, যেখানে অনেক পর্যটক সময় কাটাতে আসেন। এসব রিসোর্ট ছাড়াও বিভিন্ন পর্যটন স্পটে বিপুল পরিমাণ পর্যটক ঘুরতে আসেন। ফলে শমসেরনগর বিমানবন্দরটি চালু হলে বেশ লাভজনক রুট হবে। এটি চালু হলে ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের পাশাপাশি সেখানকার মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে এবং সরকারও রাজস্ব পাবে।
মৌলভীবাজারের নাগরিকরা বলছেন, প্রবাসী অধ্যুষিত এ জেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাসিন্দা ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। যাত্রীসেবার পাশাপাশি ভৌগোলিক কারণে এ বিমানবন্দরের সামরিক গুরুত্বও রয়েছে। তাই এটি চালু করা উচিত।
তথ্য মতে, ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও দেশের বৃহত্তম এ বিমানবন্দরটি সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর চা বাগানের ৬২২ একর জমি অধিগ্রহণ করে নির্মিত হয় এ বিমানবন্দর। বিশাল পরিসর, প্রশ^স্থ রানওয়ে, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ও অবকাঠামো সুবিধা রয়েছে। বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ফুট ও প্রস্থ ৭৫ ফুট। যে রানওয়ে দিয়ে বড় প্লেনগুলোও অবতরণ করতে পারে বলে জানান অ্যাভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৯৫ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের উদ্যোগে বেসরকারিভাবে অ্যারোবেঙ্গল এয়ার সার্ভিসের ফ্লাইট চালু করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে এ ফ্লাইট সার্ভিসটি যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। পরবর্তীকালে বিমানটিরও সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে, বর্তমানে বিমানবন্দরের অবহেলিত ও পতিত ভূমি ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল কৃষি খামার। এখানে বিমানবাহিনীর রিক্রুটমেন্ট অফিসও খোলা হয়েছে। সংস্কার করা হয়েছে রানওয়ের অল্প কিছু অংশ। বিমানবন্দরটিতে প্রতিবছর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জাতীয় ক্যাডেট কোর বিমান শাখার সদস্যদের অগ্নিনির্বাপন, প্রাথমিক চিকিৎসা, রাডার নিরাপত্তা, ফায়ারিংসহ অন্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জিএম কাদের শমসেরনগর বিমানবন্দরটি চালুর ঘোষণা দেন। কিন্তু মন্ত্রীর সেই আশ্বাস ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, বাস্তবে কাগজে কলমে আগায়নি। জিএম কাদের আওয়ামীলীগের প্রথম মেয়াদে মন্ত্রীত্ব শেষ করে চলে যাওয়ার পর পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। তখন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন রাশেদ খান মেনন। তিনি ২০১৬ সালে মৌলভীবাজার এসে শমসেরনগর বিমানবন্দরটি চালুর ঘোষণা দেন। কিন্তু সেইবারও কাজের কাজ কিছু হয়নি। সেই ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ ছিল বিমানবন্দর চালুর বিষয়টি।
পরবর্তীতে আওয়ামীলীগের তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পাওয়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. মাহবুব আলীও ২০২৩ সালের ২৩ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় এসে শমসেরনগর বিমানবন্দর চালুর ঘোষণা দেন। কিন্তু তার সেই ঘোষণারও বাস্তবায়ন হয়নি।
সর্বশেষ গত ২৭ এপ্রিল দেশের অন্য ছয় বিমানবন্দরের সঙ্গে মৌলভীবাজারের শমসেরনগর বিমানবন্দরও চালুর ঘোষণা দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এরই মধ্যে বেবিচকের চার সদস্যের একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল শমসেরনগর বিমানবন্দরে এসে সরেজমিন পরিদর্শন করেছে বলেও জানানো হয়। তারা বিমানবন্দরটি চালু করার বিষয়ে বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন জমা দিলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানানো হয়। কিন্তু বেবিচকের এই উদ্যোগে খুব বেশি আশাবাদী না হলেও আশাহত নন মৌলভীবাজারের বাসিন্দারা।
মৌলভীবাজারের বাসিন্দা প্রভাষক মো. সীতাব আলী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, অতীতে অনেকবার এ বিমানবন্দর চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। তবে এবার আমরা খুব আশাবাদী না হলেও আশাহত নই। এবারের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হবে বলে আশা রাখি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী এমএ মজিদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ব্যবসার প্রয়োজনে প্রতি সপ্তাহে ঢাকায় যেতে হয়। রেল ও সড়কপথে অনেক সময় লাগে। কিন্তু এখানে বিমানবন্দর থাকলে খুব সহজেই ব্যবসায়ীরা ঢাকাসহ সারাদেশে যেতে পারবে। এতে সময় বাঁচবে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও বৃদ্ধি পাবে। তাই বিমানবন্দরটি চালু করা জরুরি।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, যেহেতু এখানে বিমানবন্দর রয়েছে, নতুন করে তৈরি করতে হচ্ছে না, সুতরাং এটি সংস্কার করে সরকার চালু করতে পারে। এতে তাদেরও রাজস্ব বাড়বে। তেমনই বিমানবন্দরটি চালু হলে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের মানুষের যাতায়াত সহজ হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হবে ও পর্যটনের বিকাশ ঘটবে।
জানতে চাইলে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, শমসেরনগর বিমানবন্দর চালুর বিষয়ে আমাদের একটি টিম কাজ করছে, তারা অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) করছে, সেখানে কী আছে, রানওয়ে কোন অবস্থায় আছে। সেই অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) শেষ হলে বলা যাবে বিমানবন্দরটি চালুর উপযোগী কী না। শমসেরনগর বিমানবন্দর কবে নাগাদ চালু করা হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্দিষ্ট করে বলা খুব কঠিন। তবে আমরা চেষ্টা করছি, যাতে বিমানবন্দরটি চালু করা যায়।