সবার উপরে চালক সত্য!
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ মে ২০২৫, ৩:৩৫:৫৫ অপরাহ্ন
ছোট যানে বড় দুর্ভোগ- পর্ব ১
পুরো নগরী যেন সিএনজি স্ট্যান্ড
এমজেএইচ জামিল : ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- সমাজে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝাতেই মধ্যযুগে একজন খ্যাতিমান কবি চরণটি লিখেছিলেন। আর কবির ভাষার বিপরীতমুখী প্রতিফলন ঘটছে সিলেট নগরে। লোকজন বলছে- সবার উপরে সিএনজি অটোরিক্সা চালক সত্য, তাহার উপরে নাই। পর্যাপ্ত গণপরিবহন না থাকায় সিএনজিচালিত অটোরিক্সার শহরে পরিণত হয়েছে পুরো সিলেট নগরী। এত বিশাল সংখ্যক সিএনজি অটোরিক্সার পদচারণায় পুরো নগরীই সিএনজি স্ট্যান্ডে পরিণত হয়ে গেছে। এতে একদিকে বাড়ছে যানজট, অপরদিকে ঘটছে নানা দূর্ঘটনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইন ও নিয়মের ধারেন না সিএনজি অটোরিক্সার চালকরা। পুলিশ অ্যাকশনে গেলেই আসে ধর্মঘটের আল্টিমেটাম। ফলে তাদের কাছে নতি স্বীকার করতে হয় খোদ প্রশাসনকে। এতে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে সিলেটের সিএনজি অটোরিক্সা চালকেরা। ইচ্ছেমতো যাত্রী উঠা নামা এবং ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় সিএনজি চালকদের যেন অঘোষিত স্বাধীনতা। ভাড়া নির্ধারণের জন্য একাধিকবার দাবী উঠলেও সরকারী কোন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার এখতিয়ার নেই এমন কারণে গুরুত্বপূর্ণ জনদাবি উপেক্ষিত হয়ে আসছে। সিলেটে সিএনজি অটোরিক্সার চালকদের একাধিক সংগঠন থাকলেও তারা কেবল চালকদের স্বার্থ রক্ষায় কর্মসূচী ঘোষণা করে। যাত্রীদের কল্যাণে তাদের কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বিবেকের তাড়নায় তাদের অনিয়মের প্রতিবাদ করলে যাত্রীগণকে তাদের হাতে নাজেহাল হতে হয়। তাদের রোষানল থেকে সাংবাদিকও বাদ যাচ্ছেন না। ফলে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করছেনা।
জানা গেছে, সিলেট নগরীতে ২০ হাজারের মতো নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিক্সা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সিএনজি অটোরিক্সা রয়েছে এর কয়েকগুণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর যানজট নিরসনে গত এপ্রিল মাসের ১ম সপ্তাহে ৩০টি স্থানকে সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড নির্ধারণ করে দেয় সিলেট সিটি কর্পোরেশন।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমানের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই ৩০টি স্ট্যান্ড নির্ধারণের কথা জানানো হয়। স্ট্যান্ডগুলো হচ্ছে- আম্বরখানা পয়েন্ট, টিলাগড় পয়েন্ট, মদিনা মার্কেট, পাঠানটুলা, বন্দরবাজার কোর্ট পয়েন্ট, তেমুখী, টুকের বাজার, ভার্থখলা ক্বীন ব্রিজ সংলগ্ন, বাবনা পয়েন্ট, কদমতলী মুক্তিযোদ্ধা পয়েন্ট, হুমায়ূন রশীদ চত্বর, সামাদ আজাদ চত্বর, শেখঘাট জিতু মিয়া পয়েন্ট, রিকাবীবাজার পয়েন্ট, শাহপরান মেইন গেইট, মেজরটিলা ইসলামপুর বাজার, বালুচর পয়েন্ট এম.সি কলেজ ছাত্রাবাস সংলগ্ন, কুশিঘাট, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল গেটের সম্মুখে, ধোপাদিঘীরপাড় ওসমানী শিশু উদ্যান, কাজিটুলা বাজার, জেলরোড পয়েন্ট, শাহী ঈদগাহ পয়েন্ট, কদমতলী ওভারব্রীজ সংলগ্ন, চন্ডিপুল, শ্রীরামপুর, জালালাবাদ গ্যাস অফিস সংলগ্ন মেন্দিবাগ, সিসিক ২৮নং ওয়ার্ডের মকন দোকান বাজার ও শিববাড়ি বাজার।
ঐ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়- এর বাইরে অন্য যতগুলো স্থানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যানজট সৃষ্টি করা হবে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সিসিকের সেই নির্দেশনা কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তবে নিদের্শনা মানছেনা কেউ। নির্দেশনা মানতে সিসিক কিংবা প্রশাসনের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছেনা। বরং উল্টো পুরো নগরীকে অবৈধ সিএনজি অটোরিক্সা স্ট্যান্ডে পরিণত করা হয়েছে।
বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর সিটি কর্পোরেশনের সামনে যত্রতত্র সিএনজি চালিত অটোরিক্সা দাঁড় করিয়ে রাখা রয়েছে। দেখে মনে হবে এটা নগর ভবনের সামনে রাস্তা নয়, যেন একটি বিশাল সিএনজি অটোরিক্সা স্ট্যান্ড। এর পাশেই কুদরত উল্লাহ মার্কেটের সামন থেকে শুরু করে পুলিশ সুপারের কার্যালয় পর্যন্ত অটোরিক্সার লাইনের সাড়ি। বিপরীত পাশের্^ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মেইন গেইট থেকে কোর্ট পয়েন্ট পর্যন্ত পুরো জায়গাটি সিএনজি অটোরিক্সা স্ট্যান্ড। সেখানে একটি নয়, ২/৩টি লাইনে অটোরিক্সার সারির কারণে রাস্তার অর্ধেকের বেশী তাদের দখলে চলে গেছে। একটু এগিয়ে মধুবন মার্কেট থেকে শুরু করে করিম উল্লাহ মার্কেট হয়ে জেল রোড পয়েন্ট পর্যন্ত আরেকটি স্ট্যান্ড। একটু এগিয়ে ওসমানী শিশুপার্কের সামনে আরেকটি স্ট্যান্ড। অপরদিকে জেল রোড পয়েন্ট থেকে শুরু করে পুরাতন জেলের মুখ পর্যন্ত স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো রয়েছে অটোরিক্সা।
এভাবে নগরীর কিনব্রিজের মুখ, সুরমা মার্কেট পয়েন্ট, তালতলা পয়েন্ট, শেখঘাট পয়েন্টের ৩ দিকে ৩টি স্ট্যান্ড, জিন্দাবাজার পয়েন্ট, চৌহাট্টা পয়েন্ট, দরগা গেইট পয়েন্ট, রিকাবীবাজার পয়েন্ট, লামাবাজার পয়েন্ট, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আশেপাশে অন্তত ৫টি অটোরিক্সা স্ট্যান্ড, সুবিদবাজার পয়েন্ট, মদীনা মার্কেটের চতুর্দিকে অন্তত ৪টি স্ট্যান্ডসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে অন্তত দেড় শতাধিক সিএনজি স্ট্যান্ডে অবাধে চলছে যাত্রী উঠানামা।
সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি হচ্ছে নগরীর আম্বরখানায়। এই এলাকায় সিএনজি অটোরিক্সা ছাড়া অন্য কোন যানবাহন রাস্তায় দাঁড়ানো যেন নিষিদ্ধ। রাস্তার পূর্ব পাশে আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে দরগা গেইট পর্যন্ত, বিপরীত দিকেও দরগা গেইট থেকে আম্বরখানা পয়েন্ট পর্যন্ত, অপরদিকে সিলেট-সুনামগঞ্জ রোডে আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে দর্শনদেউরী, বিপরীত দিকে ইউনিমার্টের সামন থেকে আম্বরখানা মসজিদ পয়েন্ট পর্যন্ত, এয়ারপোর্ট রোডে মসজিদের সামন থেকে মজুমদারী পর্যন্ত, টিলাগড় রোডে আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে বড়বাজার পয়েন্ট পর্যন্ত পুরো এলাকা যেনো সিএনজি স্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে। এসব স্থানে কোন যানবাহন দুরে থাক অটোরিক্সা চালকদের জন্য একটা পায়ে চলার রিক্সাও দাঁড়াতে পারেনা। এভাবেই পুরো নগরী সিএনজি চালিত অটোরিক্সা চালকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, যত্রতত্র স্ট্যান্ড স্থাপন করে সড়ক দখল করেন চালকরা। এতে নগরে যানজট বেড়েই চলছে। এই বিষয়ে নগরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে যানজট নিরসনে নানা পরিকল্পনা হাতে নেয় সিসিক। বিগত সময়ে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর আমলে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সেই আলোকে জনদুর্ভোগের বিষয়টি চিন্তা করে আমরা ৩০টি স্থানে সিএনজি অটোরিকশার স্ট্যান্ড নির্ধারণ করে দিয়েছি।
তিনি বলেন, এসব দেখার দায়িত্ব পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের। কোন ভিআইপি সিলেটে আসলে তারা সাথে সাথেই রাস্তা পরিস্কার করতে পারে। তারা সুবিধামতো স্থান নির্ধারণ করতে পারে। সিসিক এসব স্ট্যান্ড ইজারা দেয়না, তাই সিসিকের তেমন দায়ও নেই। এরপরও জনদুর্ভোগ দূর করতে আমরা একটা তালিকা দিয়েছি। এখন পুলিশ প্রশাসন ও চালকদের সংগঠন মিলে সমন্বয়ের মাধ্যমে স্ট্যান্ড নির্ধারণ করতে পারেন। এতে সিসিকও পাশে থাকবে।
এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ এসএমপির মিডিয়া কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, পুলিশের দায়িত্ব অনেক। নগরে এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ প্রতিনিয়ত কাজ করছে। এর এখতিয়ার না থাকলে সিসিকের স্ট্যান্ড তালিকা করাও ঠিক হয়নি। আর যেহেতু করেছেন তখন পুলিশ, চালক ও যাত্রী-নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে করলে সবার সুবিধা হতো। আমি বিষয়টি নিয়ে কমিশনার মহোদয় এবং ট্রাফিকের ডিসি মহোদয়ের সাথে বিস্তারিত আলাপ করবো।
সিসিকের নির্ধারিত স্ট্যান্ডের বিষয়ে সিলেট জেলা সিএনজিচালিত অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাকারিয়া আহমদ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিটি কর্তৃপক্ষ আমাদের সাথে সমন্বয় ছাড়াই স্ট্যান্ড নির্ধারণের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তারা শুধু বলেছে বন্দরবাজার। কিন্তু বন্দরবাজারের কোথায় স্ট্যান্ড সেটা উল্লেখ করেনি। এভাবে তারা ৩০ টি স্ট্যান্ড তালিকায় এলাকার নাম উল্লেখ করলেও স্থানের নাম উল্লেখ করেনি। ফলে চালকরা বিভ্রান্ত হচ্ছে। আগের নিয়মেই তারা স্ট্যান্ডে যাত্রী উঠানামা করছে। সিসিক কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী ও চালক মিলে স্ট্যান্ডের স্থান নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিলে সেটি কার্যকর করা সম্ভব। অন্যথায় এসবের সুফল মিলবেনা।