ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ঝুঁকি, কতটা কমল?
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ মে ২০২৫, ১০:১৫:৩৮ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : আবারও যুদ্ধের কিনারা থেকে ফিরে এসেছে ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের এবারের চার দিনের বিশৃঙ্খল সংঘর্ষে অনেক নতুনত্ব ছিল এবং অভ্যন্তরীণ উত্তেজনার নানা বিষয় এখনো অস্থিতিশীল রয়ে গেছে। এসব কারণে চলমান যুদ্ধবিরতি পর দুই দেশের পুরোনো ‘আত্মসংযমের’ ধাঁচে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন করেছে।
এবারের যুদ্ধে নতুন প্রজন্মের সামরিক প্রযুক্তির ব্যবহার আকাশপথের সংঘাতকে চমকে দেওয়ার মতো উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ধারাবাহিক বিমান হামলা ও যুদ্ধবিমান বিধ্বংসী পাল্টা আঘাত এবারের সংঘর্ষের মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়েছিল। এই সংঘাতে প্রথমবারের মতো কাশ্মীরের পুরোনো নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ব্যাপকহারে অস্ত্রসজ্জিত ড্রোন ব্যবহার করা হয়। কোনো পাইলটকে ঝুঁকিতে না ফেলে উভয় দেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং নিশানায় আঘাত হানতে একযোগে মোতায়েন করা হয় শত শত ড্রোন।
এরপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। সরাসরি আঘাত হানে বিমানঘাঁটি ও প্রতিরক্ষা স্থাপনায়। এতে দুই পক্ষ থেকেই ভয়াবহ হুমকি উচ্চারিত হয় এবং সামরিক বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে চলে যায়।
যখন বিপর্যয়ের চূড়ান্ত মুহূর্ত চলে আসল, তখন আন্তর্জাতিক কূটনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করে। অতীতেও যা ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তবে এবারের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। বিপজ্জনক সংঘাতে ঘেরা নতুন বৈশ্বিক অধ্যায়ে উদাসীন নেতৃত্ব এবং শান্তিরক্ষায় আন্তর্জাতিক দায়িত্ববোধের ঘাটতির ভেতরে বিশ্বকূটনীতির রক্ষাকবচ এতটা দুর্বল আগে দেখা যায়নি।
সামরিক ইতিহাসবিদ ও কৌশলগত বিশ্লেষক শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের অনেকগুলোই শেষ পর্যন্ত থেমেছে বাইরের দেশের হস্তক্ষেপে।
রাঘবন আরও বলেন, ভারত বা পাকিস্তান কোনো দেশেই উল্লেখযোগ্য সামরিক শিল্পকাঠামো নেই। ফলে বিদেশি অস্ত্র সরবরাহের ওপর দুই দেশের নির্ভরশীলতা থাকে, যাতে অনেক সময় আন্তর্জাতিক চাপ কার্যকর হয়।
তবে এবার দুই পক্ষের অবস্থান আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর বলেই মনে হয়েছে। বিশেষ করে ভারত যেন দেখতে চাইছে, পূর্ববর্তী সংঘাতগুলোর চেয়ে ভিন্ন কোনো ফলাফল আদায় করা সম্ভব কি না।
শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, ভারত সরকারের মধ্যে এবার প্রবলভাবে একটি মনোভাব দেখা যাচ্ছে। সেটি হলো তারা নিশ্চিত করতে চায়, পাকিস্তান যেন এমন না মনে করে যে, তারা সহজে পার পেয়ে যাবে বা পাল্টা জবাব দিতে পারবে। এটা নিঃসন্দেহে উত্তেজনা বৃদ্ধির একটি কারণ।
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জালে আবদ্ধ ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এই সংঘাতের পর অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। আর এটা সম্ভবত এমন এক সংঘর্ষের সম্ভাবনা তৈরি করছে, যা আবারও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
রোববার পর্যন্ত এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি যে পাকিস্তান ও ভারত তাদের ইতিমধ্যে শীতল হয়ে পড়া কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের কোনো উদ্যোগ নিয়েছে, কিংবা পরস্পরের নাগরিকদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ভারতের পক্ষ থেকেও দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সিন্ধু পানিচুক্তি মেনে চলার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানের জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামাবাদ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, নদীর পানি আটকে দেওয়ার যেকোনো পদক্ষেপকে তারা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল হিসেবে বিবেচনা করবে।
২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে এক সন্ত্রাসী হামলার পর দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল। ওই হামলায় ২৬ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করলেও ইসলামাবাদ সেই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে।
এই সংকটের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার ৬ বছরের তুলনামূলক এক শান্তিপূর্ণ পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল। এ সময়জুড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানকে ঘিরে একটি দ্বিমুখী কৌশল অনুসরণ করেছেন। তা হলো একদিকে ন্যূনতম কূটনৈতিক যোগাযোগ রেখে প্রতিবেশী দেশটিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে বিচ্ছিন্ন রাখা এবং অন্যদিকে নিজ দেশে বিশেষ করে কাশ্মীর উপত্যকায় সামরিকীকরণ আরও জোরদার করা।
২০১৬ ও ২০১৯ সালে সন্ত্রাসী হামলার পর সামরিক জবাব দিয়ে ভারত এক ধরনের কড়া প্রতিক্রিয়ার রীতি গড়ে তোলে। এর ফলে গত মাসের হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে শক্তিশালী সামরিক জবাব দেওয়ার রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়।
তবে ভারতের সামরিক বাহিনীর জন্য এ পথ সহজ ছিল না। সর্বশেষ ২০১৯ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতের অবস্থান ছিল বিব্রতকর। সেবার ভারতের একটি পরিবহন হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে এবং পাকিস্তানি বাহিনী সোভিয়েত যুগের একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে তার পাইলটকে আটক করে। এবারও ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে পাকিস্তান। এ থেকে ভারতের সেনাবাহিনী আধুনিকায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত সপ্তাহে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভারত তার হারানো মর্যাদা এবং অতীতের সব বাধাবিপত্তিকে হামলার মাধ্যমে আড়াল করতে চেয়েছিল। তবে বিশ্লেষকেরা বলেছেন, যেভাবে যুদ্ধের পরিস্থিতি এগিয়েছে, তাতে প্রায়োগিক বা কৌশলগত স্তরে উন্নতির কোনো ইঙ্গিত দেখা যায়নি।
গত বুধবার আকাশপথে প্রথম ধাপের হামলায় ভারত শত্রু ভূখ-ের গভীরে এমন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে, গত দশকগুলোতে যেমনটা তারা কখনোই করেনি। সব সূত্র অনুযায়ী, এসব হামলা ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর’ সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনার খুব কাছাকাছি আঘাত হানে। এর মাধ্যমে তাদের পক্ষে বিজয়ের দাবি করা সম্ভব হয়।
পরবর্তী সময়ে প্রতিদিনই ভারত ও পাকিস্তানের উভয় পক্ষের বক্তব্যে এমন ইঙ্গিত থাকত যেন তারা কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করেছে এবং সংযত হওয়ার জন্য আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু প্রতিরাতই ছিল হানাহানি ও হামলায় পরিপূর্ণ। সীমান্তজুড়ে দূরপাল্লার প্রচলিত গোলাবর্ষণ আরও তীব্র হতে থাকে। এ কারণে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে।
ড্রোন ও বিমান হামলা ক্রমে তীব্রতর হয়ে ওঠে। এমনকি উভয় দেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল সামরিক ও কৌশলগত স্থাপনাগুলো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। বড় আশঙ্কা ছিল এই যে, পরমাণু অস্ত্রধারী দুই সতর্ক প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের জন্য দ্রুত উত্তেজনা বৃদ্ধির সিঁড়ির পরবর্তী ধাপটি কী ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র কূটনৈতিক চাপ সক্রিয় হওয়ার পেছনে মাঠপর্যায়ে সৌদি আরব ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের ভূমিকা ছিল স্পষ্ট।এই চাপের কারণ শুধু এটা নয় যে হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলো ক্রমেই সংবেদনশীল বিভিন্ন এলাকার কাছাকাছি চলে আসছিল। বরং তার থেকেও বড় আশঙ্কা ছিল, উত্তেজনা আরও বাড়লে পরমাণু অস্ত্রধারী এই সতর্ক দুই রাষ্ট্র পরবর্তী ধাপে কী ধরনের ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে এগোতে পারে-সেটি।
গত শনিবার রাতে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার কিছুক্ষণ আগে থেকে ভারতীয় কর্মকর্তারা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন, ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে আরেকটি সন্ত্রাসী হামলা হলে পাল্টা জবাবও হবে ততটাই কঠোর। তবে পাকিস্তান এ নিয়ে ততটা ভীত মনে হচ্ছেনা। কারণ এবারও তারা তাদের শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার জানান দিয়েছে আধুনিক সব রণকৌশলের মাধ্যমে। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও আসলে যুদ্ধের ঝুঁকি কতটা কমল?