সীমান্তে ক্রমাগত পুশ-ইন, বাড়ছে উদ্বেগ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মে ২০২৫, ১২:৩০:৩৮ অপরাহ্ন
সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই ঠেলে দেয়ার চেষ্টা
জালালাবাদ রিপোর্ট : সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্তে ভারতের পুশ-ইনের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। নিয়ম-কানুন ছাড়াই সাম্প্রতিক সময়ে জোরপূর্বক এই প্রবণতা ও ভারতের আচরণ বন্ধুসুলভ নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একইসাথে কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বেগজনক বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকা ৯ মে দিল্লিকে একটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে পুশ ইনের মতো অমানবিক পদক্ষেপ থেকে ভারত বিরত থাকার প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে এখনও উত্তর পাওয়া যায়নি। এই অবস্থায় বুধবার সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত থেকে দুই দফায় ৬০ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি। এছাড়া কানাইঘাট উপজেলার আটগ্রাম সীমান্তে ১৬ জন নারী ও পুরুষকে ‘পুশ ইন’ করেছে ভারতীয় সীামন্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ।
এর আগে খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে কয়েক দফায় ২০২ জনকে পুশ-ইন করে ভারত।
গতকাল বৃহস্পতিবারও কুলাউড়া উপজেলার মুরইছড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে ১৪ জন এবং বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের গানদাইল সীমান্ত দিয়ে ১৬ জনকে পুশ ইন করেছে বিএসএফ। এ সময় বিজিবি তাঁদের আটক করেছে।
সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এভাবে আটককৃতদের কয়েক দফায় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ।
পহেলগাম হামলার পর ভারতের নানা রাজ্যে ‘অনুপ্রবেশকারী’ খোঁজার অভিযান শুরু হয়েছিল। এর অংশ হিসেবে অসংখ্য মানুষকে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে অনেককে আটক করা হয়েছে।
রাজস্থানে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ চিহ্নিত করার অভিযানে ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলমানও আটক হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিবিসি এরকম একাধিক ভারতীয় বাংলাভাষী আটক হওয়ার খবর পেয়েছে।
ইতিমধ্যেই যাদের ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করতে পেরেছে রাজস্থান পুলিশ, তাদের প্রথম দলটিকে বুধবার যোধপুরের বিমানবন্দর থেকে বিশেষ বিমানে চাপিয়ে ত্রিপুরার আগরতলায় পাঠানো হয়। প্রথম দলে ১৪৮ জন চিহ্নিত আছেন বলে রাজস্থান থেকে বিবিসির সংবাদদাতা জানিয়েছেন। আগরতলার বিমানবন্দর সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওই বিশেষ বিমানটি বুধবার ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ সেখানে পৌঁছেছে। ধারণা করা হচ্ছে, স্থানান্তর করা এই ব্যক্তিদের বাংলাদেশে পুশ-ব্যাক করা হবে।
ওদিকে গুজরাত থেকে এর আগে বড় সংখ্যায় ধরপাকড় হয়েছিল-যাদের মধ্যে অনেককে ‘বাংলাদেশি’ বলে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেখানকার পুলিশ।
রাজস্থানেও গত কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে বাংলাভাষী মুসলমানদের আটক করা হচ্ছে। এদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়ের বাংলাভাষী মুসলমানরাও আছেন।
ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলছে, গত কয়েকদিনে তারা ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলমানদের কাছ থেকে অন্তত ২০০টি অভিযোগ পেয়েছে, যারা দাবি করছে যে পরিচয় নিশ্চিত করার নাম করে তাদের নানা জায়গায় আটকে রেখেছে রাজস্থান পুলিশ। উদ্দেশ্য বাংলাদেশে পুশ ইন করা।
রাজস্থান পুলিশের বরাত দিয়ে জয়পুর থেকে বিবিসি-র সহযোগী সংবাদদাতা জানান, বুধবার পর্যন্ত ১ হাজার ৮ জনকে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে আটক করা হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে ৭৬১ জনকে পুলিশ ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে প্রচার করছে।
বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিতদের সবাইকেই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে রাজস্থান পুলিশ জানিয়েছে। তারই প্রথম ধাপ হিসেবে বুধবার ১৪৮ জনকে বিশেষ বিমানে তুলে দেওয়া হয়।
এর আগে বুধবার সকালে জয়পুরের প্রতাপ নগরে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের আটকে রাখার জন্য তৈরি করা ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ থেকে চারটি বাসে চাপিয়ে যোধপুর বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয় তাদের।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে যে পুশ-ইনের সাম্প্রতিক ঘটনা ঘটেছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। উদ্বেগজনক এ কারণে যে, দুদেশের মধ্যে এই ধরনের পরিস্থিতি উদ্ভব হলে তার নিরসনের জন্য আন্তর্জাতিক রীতিনীতি যেমন রয়েছে, পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সহযোগিতার চুক্তিও রয়েছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক বলেন, ‘এই পুশ-ইন আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী। তারা শুধু বাংলাদেশেই পুশ-ইন করছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে গুজরাটেও তারা কোনো আইন মানছে না। সেখানে বাংলাদেশি বলে যাদের আটক করেছে তাদের প্রায় সবাই ভারতীয় মুসলমান।ভূরাজনীতি বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শামীম কামাল বলেন, ভারতের সাথে যে কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনতি ঘটেছে, সেটা এই সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট এর মাধ্যমে, পুশ-ইনের মাধ্যমে এটি দীর্ঘায়িত এবং জটিল আকার ধারণ করতে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। সুতরাং সেখানে কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ করা উচিত।
‘এটা পরিকল্পিত পুশ-ইন’ :
বিজিবি জানিয়েছে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় পুশ-ইন না করায় বিএসএফের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া পুশ-ইন রোধে সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে।
বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, এটা পরিকল্পিত পুশ-ইন। সীমান্তের দুর্গম এলাকা যেখানে সাধারণভাবে নজরদারি করা যায় না সেইসব এলাকা থেকে পুশ-ইন করা হচ্ছে। কিছু রোহিঙ্গাকে পুশ-ইন করা হয়েছে, যারা ভারতে ইউএনএইচসিআরের রেজিষ্টার্ড। তারা যে দেশের রিফিউজি সেই দেশে পাঠাতে পারত। এটা ন্যাক্কারজনক।
ভারতকে বাংলাদেশের চিঠি :
ভারতকে পাঠানো চিঠিতে অবিলম্বে পুশ-ইন বন্ধের অনুরোধ জানানো হয়। এতে বলা হয়, পুশ-ইনের পদক্ষেপগুলো ১৯৭৫ সালের সীমান্ত কর্তৃপক্ষের জন্য যৌথ ভারত-বাংলাদেশ নির্দেশিকা, সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (সিবিএমপি) ২০১১ এবং বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের আলোচনায় দুই পক্ষের পারস্পরিক সম্মত সিদ্ধান্তের পরিপন্থি। এতে আরও বলা হয়, কোনো ব্যক্তির বাংলাদেশি নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর বিদ্যমান প্রক্রিয়া মেনে বাংলাদেশ তাদের ফেরত নেবে। এর ব্যত্যয় হলে দুই দেশের বোঝাপড়ার মধ্যে বিঘœ সৃষ্টি করবে। একইভাবে বলপূর্বক বাস্তুচ্যূত মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশের পরিবর্তে তাদের আদি নিবাস মিয়ানমারেই ভারতের ফেরত পাঠানো উচিত। কোনোভাবে ভারতীয় নাগরিকদের জোর করে বাংলাদেশে পুশ-ইন করাটা উচিত হবে না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে এ ধরনের পুশ-ইন অগ্রহণযোগ্য এবং তা পরিহার করা উচিত।