দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন :১৬ বছর একটি নিরবচ্ছিন্ন ‘ভূমিকম্পে’ কাঁপছিল বাংলাদেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মে ২০২৫, ৯:৩৯:২০ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশ একটি নিরবচ্ছিন্ন ‘ভূমিকম্পে’ কাঁপছিল। বললেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ সরকারের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের প্রতি ইঙ্গিত করে এ কথা বলেন ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ২০২৪ সালের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার সরকার।
এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলছেন, যা ধ্বংস হয়ে গেছে, তার সবকিছু ঠিক করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি এবং জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে, আমরা আশাবাদী। এই আশাবাদই এখন প্রয়োজন। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে তাঁর শাসনামলের বাড়াবাড়ির চিত্র প্রকাশ্যে আসছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে সংগঠিত ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গৃহীত সংস্কার উদ্যোগসহ বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। এই প্রতিবেদনে ড. ইউনুসের এসব বক্তব্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর প্রকাশিত এক শ্বেতপত্রে অভিযোগ করা হয়, তাঁর (শেখ হাসিনা) শাসনামলে বছরে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ ও জেনোসাইডসহ (গণহত্যা) বিভিন্ন অভিযোগে মামলার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ক্ষমতার এমন অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি রোধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরের সব দলই গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছে। তবে বিপ্লবের ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সহজ হচ্ছে না।
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক ইউনূস বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, সংবিধান—সংস্কারের জন্য সুপারিশ দিতে কমিশন গঠন করতে শুরু করেন।
এই কমিশনগুলোতে রয়েছেন নাগরিক সমাজ ও একাডেমিক অঙ্গনের বিশেষজ্ঞরা। এসব কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার আরেকটি কমিশন (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) গঠন করে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এখন পর্যন্ত মোট ১৬৬টি সুপারিশ একত্র করেছে। সেগুলোকে একটি স্প্রেডশিটে তালিকাভুক্ত করে মতামতের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৫টি রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে।
এই ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একটি ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করবে, যা নির্বাচন আয়োজনের পথ সুগম করবে এবং একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার সূচনা করবে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইউনূস।
কিন্তু ঐকমত্যে পৌঁছানোটা সহজ ব্যাপার নয়। প্রথমত, কোন কোন কমিশন থাকা উচিত, তা নিয়ে রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল খাত তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য একটি কমিশন থাকা উচিত ছিল। আবার অনেকেই শিক্ষা খাত নিয়ে অবহেলার অভিযোগ তুলেছেন।
বিলম্বে গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ঘিরে সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। নারীদের আরও বেশি অধিকার দিতে এই কমিশনের সুপারিশে ইসলামি উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যার বিরুদ্ধে ইসলামপন্থী দলগুলো ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে।
তবু সংস্কার কমিশনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আশাবাদী। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত কিছু পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন, যেমন হাইকোর্টে বিচারপতি নিয়োগের জন্য একটি স্বাধীন প্রক্রিয়া।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের দ্বিতীয় পর্ব ১৫ মের পরপরই শুরু হবে। তবে আগামী আগস্টের মধ্যে একটি সনদ চূড়ান্ত হওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
যদি এই সময়সূচি অনুযায়ী সবকিছু এগোয়, তাহলে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে (এবং তিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন না)। তবে এই বিলম্বের কিছু মূল্য ইতিমধ্যেই গুনতে হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করেছে, তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুর্বলই রয়ে গেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও নাজুক।
এক জরিপ অনুযায়ী, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৬০ শতাংশ মনে করেন, সরকার পরিবর্তনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। রাস্তায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিক্ষোভকারীদের সবচেয়ে সাধারণ দাবি হলো, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলকব্যবস্থা নেওয়া।
১২ মে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করে। যেকোনো নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করে ইসি। ক্ষমতার বাইরে থাকলেও আওয়ামী লীগ এখনো দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হতে পারে।