গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা জাতিগত নির্মূলের ইঙ্গিত: জাতিসংঘ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ মে ২০২৫, ১০:০৬:০২ অপরাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত বিমান হামলায় মাত্র একদিনেই প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১৪৬ জন। যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভেঙে পড়ার পর থেকে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ সময়গুলোর একটি। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া হামলায় মোট নিহতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে, জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
গাজার ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালের পরিচালক মারওয়ান আল-সুলতান শনিবার সকালে বলেন, “মধ্যরাত থেকে এখন পর্যন্ত আমরা ৫৮ জন শহীদের মরদেহ গ্রহণ করেছি। আরও অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে। হাসপাতালের ভেতরের অবস্থা ভয়াবহ।” ইসরায়েলের এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান ভলকার টার্ক।
তিনি বলেন, “এই ধারাবাহিক বোমাবর্ষণ এবং মানবিক সহায়তা বন্ধ রাখার মাধ্যমে গাজায় স্থায়ীভাবে জনসংখ্যার কাঠামো বদলে দেওয়ার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন এবং এক ধরনের জাতিগত নির্মূল।” জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বাগদাদে আরব লীগের শীর্ষ সম্মেলনে এক ভাষণে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।
ইসরায়েল জানায়, গাজায় এই হামলা হচ্ছে ‘অপারেশন গিডিয়নের রথ’ নামে একটি অভিযান শুরু করার অংশ, যার লক্ষ্য ‘যুদ্ধের সব লক্ষ্য পূরণ করা’। এই অভিযানে সীমান্তে ব্যাপক সেনা মোতায়েন এবং গাজার কিছু অংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলের দাবি, এই চাপের মাধ্যমে তারা চায় হামাস যেন অক্টোবর ২০২৩-এর হামলায় নেওয়া জিম্মিদের মুক্তি দেয়। ওই হামলায় ইসরায়েলের ১,২০০ জন নিহত হন এবং ২৫০ জন জিম্মি করা হয়। এখনো ৫৭ জন জিম্মি রয়েছে হামাসের হাতে।
এই পরিস্থিতির মধ্যে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চার দিনের মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষে ফিরে গেছেন। সফরের সময় সৌদি আরব, কাতার ও ইউএই যুক্তরাষ্ট্রে বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয়।
কিন্তু অনেকের আশা ছিল, ট্রাম্পের সফরে গাজা নিয়ে শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি হবে। উল্টো তিনি গাজাকে “স্বাধীনতার এলাকা” বানানোর পরিকল্পনার কথা বলেন, যা অনেকের মতে গাজা দখল ও পুনঃগঠনকে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ইঙ্গিত।
হামাসের মুখপাত্র তাহের আল-নুনো শনিবার নিশ্চিত করেছেন যে কাতারের রাজধানী দোহায় নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। উভয় পক্ষ “শর্তহীন” আলোচনায় বসেছে বলে জানান তিনি।
এর আগে, জানুয়ারির যুদ্ধবিরতি ভেঙে যায় মার্চে, যখন ইসরায়েল দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় যেতে অস্বীকৃতি জানায়। ২ মার্চ থেকে ইসরায়েলের সম্পূর্ণ সাহায্য অবরোধ গাজায় বিপুল খাদ্য সংকট ও অপুষ্টি তৈরি করেছে। শিশুদের মধ্যে অনাহার ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যু বেড়েছে।
ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়েছে অনেক হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্র, চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রায় নেই বললেই চলে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, “গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে আসছে। এখনই সহায়তা চালু না করলে, হাজারো বেঁচে যাওয়া মানুষও ঝুঁকিতে পড়বে।”
ইসরায়েল বলছে, তারা গাজায় নিজেদের সেনাবাহিনীর পাহারায় বেসরকারি সংস্থা দিয়ে সহায়তা বিতরণ করবে। এই উদ্যোগকে সহায়তা সংস্থাগুলো ‘অকার্যকর ও অবৈধ’ বলে উল্লেখ করেছে। তারা বলছে, এতে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি রয়েছে।
ফ্লেচার বলেন, “আমরা সাহায্য নিশ্চিত করার কার্যকর কাঠামো তৈরি করেছি যা গাজার নাগরিকদের কাছে সহায়তা পৌঁছে দেয়, হামাসের হাতে নয়।” ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তা বলেন, “গাজা থেকে আসা খবরে আমি স্তব্ধ। অনাহারে থাকা মানুষ, বারবার হাসপাতালে হামলা এই সহিংসতা বন্ধ হওয়া দরকার।”
জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্বেগ জানিয়ে বলে, “এই সামরিক অভিযান বাকি জিম্মিদের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলছে, যার মধ্যে জার্মান নাগরিকও থাকতে পারেন।”
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এক ধাপ এগিয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাবনা আনার পরিকল্পনা করছেন, যাতে ফিলিস্তিনে মানবিক সহায়তা অবাধে প্রবেশের দাবিতে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় চাওয়া হয়।