আসন সীমানায় বড় পরিবর্তনের আভাস
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ মে ২০২৫, ১০:০৭:০৯ অপরাহ্ন
৬৬ আসনের ৪১৬ আবেদন ইসিতে ♦ কমতে পারে শহরে, বাড়তে পারে গ্রামে
জালালাবাদ রিপোর্ট : ডিসেম্বরে না জুনে নির্বাচন-এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং রাজনৈতিক দল ও সরকারের মাঝে যখন দরকষাকষি চলছে, তখন সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আসন সীমানা পুনর্নির্ধারণে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নতুন উদ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যা ২০০৮ সালের পর এবারই সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এরইমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার একটি সংশোধিত অধ্যাদেশ জারি করে আইনি জট খুলে দিয়েছে, ফলে কমিশন পুরোদমে কাজ শুরু করেছে।
ইসি বলে আসছিল, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের একটি ধারায় মুদ্রণত্রুটি আছে। যে কারণে ইসি চাইলেও নতুন করে বড় আকারে সীমানায় পরিবর্তন আনতে পারবে না, শুধু কোনো প্রশাসনিক পরিবর্তন থাকলে তা অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। তাই ইসি এখানে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছিল।
সংশোধিত অধ্যাদেশ জারির পর ১৯ মে পর্যন্ত ইসিতে জমা পড়েছে ৬৬টি আসন নিয়ে ৪১৬টি আবেদন, যার প্রায় ৯০ শতাংশই বিএনপিপন্থীদের। অধিকাংশ আবেদনেই ২০০১ সালের সীমানায় ফিরে যাওয়ার দাবি করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে পিরোজপুর-২ (১০৩টি), কুমিল্লা-১০ (৯২টি), ঢাকা-৭ (৩৬টি), ঢাকা-১, ২ ও ৩ মিলিয়ে (২৩টি)।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এবারের সীমানা পুনর্নির্ধারণে শহরভিত্তিক আসন কিছুটা কমিয়ে গ্রামীণ এলাকা বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ অনেক শহরাঞ্চলে জনসংখ্যার তুলনায় আসন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। কমিশন জনসংখ্যা ও ভোটার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টায় আছে।
ইসি কমিশনার ও সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিটির সভাপতি মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, আমাদের নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য নেই। যাদের আবেদন যুক্তিসংগত, তা বিবেচনায় নেওয়া হবে। তবে সব আসনেই পরিবর্তন হবে, এমন নয়। তিনি জানান, এক আসনের সীমা পরিবর্তনে আশেপাশের আসনগুলোতেও প্রভাব পড়তে পারে। এ কারণেই এবার ব্যাপক পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।
নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন দায়িত্ব নিয়েই ইসির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন ২০০১, ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে কী পরিবর্তন হয়েছিল তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ তৈরি করতে। বিশেষ করে ২০০১ সালের কাঠামোয় ফেরার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তবে উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ইসি বড় কোনো পরিবর্তন না করে মাত্র ২৫-৫০টি আসনে সীমিত রদবদল করে। ২০১৮ সালে সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত আইনের ৮ ধারায় সংশোধন এনে বড় পরিবর্তনের পথও বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। এই ধারাটি এবার অন্তর্বর্তী সরকার সংশোধন করেছে, ফলে আইনি বাধা নেই।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, সীমানা পরিবর্তনের জন্য ১৯ মে পর্যন্ত ইসিতে জমা পড়েছে ৬৬টি আসন নিয়ে ৪১৬টি আবেদন। এরমাঝে রাজধানী ঢাকা, সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আবেদন জমা পড়েছে। তবে সীমানা পরিবর্তন চেয়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছে পিরোজপুর-২ আসনে। এই আসনে অন্তত ১০৩টি আবেদন জমা পড়েছে।ঢাকা-১, ২ ও ৩ এই তিনটি আসনের সীমানায় পরিবর্তন চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে ২৩টি।ঢাকা-৭ আসনের সীমানায় পরিবর্তন চেয়ে ৩৬টি আবেদন জমা পড়েছে।কুমিল্লা-১, ২, ৬, ৯, ১০ সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন চেয়ে মোট ১০৪টি আবেদন জমা হয়েছে। মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ ও রাজবাড়ী জেলা থেকে অর্ধশতাধিক আবেদন করা হয়েছে নির্বাচন কমিশন।
অন্য জেলাগুলোর মধ্যে বরিশাল-৪ সংসদীয় আসন থেকে হিজলা উপজেলাকে কর্তন করে বরিশাল-৩ আসনের সঙ্গে যুক্তের জন্য একটি আবেদন পড়েছে। এছাড়া রংপুর-১ আসনে একটি, গাইবান্ধা-৩ আসনে একটি, সিরাজগঞ্জ-১ আসনে একটি, সিরাজগঞ্জ-২ আসনে দুটি, সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে তিনটি ও সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে ৫টি আবেদন রয়েছে। যশোর-২ আসনে একটি, সাতক্ষীরা-৩ আসনে একটি সাতক্ষীরা-৪ আসনে একটি, বরগুনা-১ ও ২ আসনে ৮টি, ঝালকাঠী-২ আসনে একটি, নেত্রকোনা-৫ আসনে একটি, কিশোরগঞ্জ-২ আসনে একটি, গাজীপুর-১ আসনে একটি, গাজীপুর-৩ আসনে পাঁচটি, গাজীপুর-৫ আসনে চারটি আবেদন রয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার কয়েকটি আসনের সীমানা পরিবর্তন চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে।
নির্বাচন কমিশনার ও সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণসংক্রান্ত কমিটির সভাপতি মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, যারা আবেদন করেছেন, তাদের যুক্তিগুলো আমরা দেখছি। তাদের আবেদনের যৌক্তিক বিষয়গুলো বিবেচনা করা হচ্ছে। আমাদের নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য নেই। ২০০১ সালের সীমানায় ইসি ফিরবে কীনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা আবেদন করেছেন, তাদের যুক্তি সঠিক হলে, সেটা দেখব। তবে সব আসনেই সীমানায় রদবদল হবে বিষয়টি তেমন নয়। অনেক আসন রয়েছে, যেগুলো বিদ্যমান সীমানাই যৌক্তিক।
এদিকে, সংসদীয় আসন পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ২০২৬-এর চেহারা অনেকটাই বদলে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০০১ সালের কাঠামোয় ফেরার জোরালো দাবি, ইসির নতুন উদ্যোগ এবং আইনি সংশোধন-সব মিলিয়ে এবার বড়সড় সীমানা পরিবর্তনের বাস্তব সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে এটি কেবল প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস নয়, বরং নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরির এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এখন দেখার পালা নির্বাচনের আগে এক্ষেত্রে কতটুকু সফল হতে পারে ইসি।