ড. ইউনূস পদত্যাগ ‘ভাবনা’ : দেশে হঠাৎ রাজনীতির উত্তাপ

জালালাবাদ রিপোর্ট : দেশ তথা রাজনৈতিক অঙ্গণে খুব দ্রুততার সাথে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। এই ঘটনাপ্রবাহে সর্বশেষ সংযোজন-অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের ‘ভাবনা’। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার রাত থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। ঝড় বয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর প্রেক্ষিতে জামায়াত আহবান জানায় সর্বদলীয় বৈঠকের।

এর একদিন পর অর্থাৎ গতকাল শুক্রবার জানা গেলো পদত্যাগ করছেন না ড. ইউনুস। প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করবেন না। তাঁর ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ ডেমোক্রেটিক ট্রাঞ্জিশনের (গণতান্ত্রিক উত্তরণ) জন্য অধ্যাপক ইউনূসের দরকার আছে। শুক্রবার দুপুরের দিকে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা বলেন।

তবে কয়েক ঘন্টা পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ-সংক্রান্ত বিষয়ে ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসের পরিবর্তন এনেছেন বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। পরিবর্তিত স্ট্যাটাসে তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে যে স্ট্যাটাস তিনি দিয়েছিলেন, তা তার ব্যক্তিগত মতামত।

পদত্যাগ আলোচনা সূত্রপাত হয় বৃহস্পতিবার। ওনদিন দুপুরে উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠক শেষে অনির্ধারিত আলোচনায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে ক্ষোভ ও হতাশার কথা তুলে ধরেন তিনি। একাধিক উপদেষ্টা ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। বেরিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে পারেন এমন খবর পেয়ে তার সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি। দেখা করার পর বুঝতে পারেন পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন ড. ইউনুস।

একইদিন সন্ধ্যায় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাকে সরানোর দাবি তোলে বিএনপি। এর আগে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে ঢাকার রাজপথে বিক্ষোভও করেছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা।

ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে গত ১৪ মে থেকে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা আন্দোলন শুরু করে। পরে তা দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে গিয়ে ঠেকে।

বিএনপি পদত্যাগের দাবি করলেও তা অস্বীকার করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ। গতকাল শুক্রবার একটি বেসরকারি টেলিভিশনে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ড. ইউনূসের পদত্যাগ দাবি করেনি বিএনপি, এটি তার ব্যক্তিগত বিষয়।

এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টাকে ‘বিএনপির মুখপাত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পদত্যাগে বাধ্য করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এনসিপি’র এক শীর্ষ নেতা। এই খবরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নানাভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানান।

দলগুলোর প্রতিক্রিয়া :
বৃহস্পতিবার দিনভর নানা ঘটনার পর বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরানোর দাবি জানিয়েছে।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা যাদের বক্তব্যে এবং কর্মকা-ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেয়ার দাবি আমরা তুলেছিলাম।

সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাদের অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্য আবারও নতুন বির্তকের জন্ম দিয়েছে। সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাকে অব্যাহতি প্রদান করতে হবে। ফ্যাসিবাদের দোসর কয়েকজন উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি আমরা ইতিপূর্বে অনেক বার উত্থাপন করেছি।

এমন পরিস্থিতিতে কাউকে দোষারোপ না করে অনেকটা দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয় জামায়াত। জামায়াতে ইসলামী আমীর ডা: শফিকুর রহমান দেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার জন্য প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানান।

বৃহস্পতিবার জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের এক বৈঠকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পর প্রধান উপদেষ্টার প্রতি এই আহ্বান জানানো হয় বলে দলটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। এর আগে এক ফেসবুক পোস্টে জামায়াত আমীর ফ্যাসিবাদবিরোধী সব পক্ষকে মান, অভিমান ও ক্ষোভ একদিকে রেখে জাতীয় স্বার্থে দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানান।

এরপর রাতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া এক পোস্টে জানানো হয়, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ পাঁচটি দলের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে লেখেন, দেশ ও জাতির স্বার্থে অপ্রত্যাশিতভাবে আসা বিভাজন মিটিয়ে ফেলতে হবে। তার ভাষ্য, আমরা সবাই এক হয়েছিলাম বলে দীর্ঘ দেড় যুগের শক্তিশালী ফ্যাসিবাদকে তছনছ করতে পেরেছিলাম। আমরা খ- বিখ- হলে পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশী-বিদেশী দোসরেরা আমাদের তছনছ করার হীন পায়তারা করবে। দেশের জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনও বিকল্প নেই।

সরকারের কে কী বলছেন?
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ওনদিন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি বলেন, বিএএল, নর্থ ও দিল্লি জোটভুক্ত হয়ে যে কুমির ডেকে আনছেন তা আপনাদেরকেই খাবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘নর্থ’ বা ‘উত্তর’ বলতে সাধারণত: ক্যান্টনমেন্ট বোঝানো হয়। ‘বিএএল’ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংক্ষিপ্ত রুপ।

তিনি লেখেন, আমাদের না আছে মরার ভয় না আছে হারাবার কিছু। একমাত্র আফসোস, গণতান্ত্রিক রুপান্তর আর এদেশের মানুষের ভাগ্য কোনটাই ইতিবাচক পথে যাবে না আরকি। স্বপ্ন দেখে স্বপ্নভঙ্গের কষ্টই বোধহয় এদেশের ভাগ্য।

তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে লিখেছেন, পূর্বের যে কোনো বিভাজনমূলক বক্তব্য ও শব্দচয়নের কারণে দুঃখপ্রকাশ করছেন করেন। আলম লিখেছেন, ব্যক্তির আদর্শ, সম্মান ও আবেগের চেয়ে দেশ বড় দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অনিবার্য। আগেকার যে কোনো বক্তব্য ও শব্দচয়ন, যা বিভাজনমূলক ছিল- সেগুলোর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আর একদিনও সরকারে থাকলে অভ্যুত্থানের সকল শক্তির প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতা রেখে কাজ” করতে চাওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ করেছেন মাহফুজ আলম।

সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ড. ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এখন কিছু কিছু গুরু দায়িত্ব আছে, সেগুলো পালনের সঙ্গেও তো মাসের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। যদি কোনো কিছু বলার থাকে, আমি নির্বাচনের প্রশ্নেও বলেছি, দায়িত্ব পালনের প্রশ্নেও বলেছি-ওটা আপনারা ওনার (প্রধান উপদেষ্টার) কাছ থেকেই শুনবেন।

চাপের প্রসঙ্গে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ধরুন, প্রত্যাশার একটা চাপ হচ্ছে যে আমরা পারফর্ম করতে পারছি কি না। আমাদের বিবেচনায় ওটাই একমাত্র চাপ। এর বাইরে আর কোনো চাপ নেই।