মেয়ে সেজে মুক্তিযোদ্ধা মামার ভাতা তুলছেন ভাগনী!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ মে ২০২৫, ৮:১৬:১৬ অপরাহ্ন
আব্দুল জলিল, কোম্পানীগঞ্জ (সিলেট) : সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে প্রায় এক দশক থেকে মুক্তিযোদ্ধা মামার ভাতা তুলে নিচ্ছেন ভাগিনী। জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবার নাম পরিবর্তন করে ভাগিনী থেকে হয়েছেন মেয়ে। জালিয়াতি করে এখন পর্যন্ত তুলেছেন প্রায় ১৭ লক্ষ টাকা। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে উপজেলার উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের বিজয় পাড়ুয়া গ্রামে। এ নিয়ে এলাকায় চলছে তোলপাড়।
জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা আলমাছ আলী যুদ্ধের ৬ বছর পর নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। কিন্তু তার বোন আছতুরা বেগমের মেয়ে মোছা: ফজরুন নেছা মামাকে পিতা বানিয়ে নিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সকল সুযোগসুবিধা। যা অকপটে স্বীকার করেন ফজরুনের মা আছতুরা বেগম। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ ও সমাজ সেবা কর্মকর্তা তদন্ত করছেন বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত জাতীয় পরিচয় পত্রে মোছা: ফজরুন নেছার বাবার নাম ছিল মো: তোতা মিয়া আর মায়ের নাম ছিল মোছা: আছতুরা বেগম। ডিসেম্বরের ১ তারিখ এনআইডি কার্ডে বাবার নাম পরিবর্তন করে আলমাছ আলী লিখেন। তবে মায়ের নাম আছতুরাই রেখে দেন। এনআইডি পরিবর্তন করে মুক্তিযোদ্ধার আপন বোনকে স্ত্রী আর নিজে হয়ে যান ভাগিনী থেকে মেয়ে। এই জালিয়াতির পথ বের করেন ফজরুন নেছার স্বামী চান মিয়া (কালা)।
বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসী বেশ কয়েকবার অভিযোগও দিয়েছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২০ সালে তাদের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়। তখনকার তদন্তকারী সমাজ সেবা কর্মকর্তা জনি রঞ্জন দে’র ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের সম্মানী ভাতা ফের চালু হয়।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তখন ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা স্বাক্ষী দেন ফজরুন নেছা আলমাছ আলীর মেয়ে বলে। কিন্তু এই ৬ জনের ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত জানিয়েছেন তখনকার উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তার লেখা একটি কাগজে তারা স্বাক্ষর দিয়েছেন। তাতে কি লেখা ছিল তা তাদের পড়ে শুনানো হয়নি।
স্বাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালিক জানান, আলমাছ আলীর কোন সন্তান ছিল না। ফজরুন নেছা তার বোনের মেয়ে। তার বাবা তোতা মিয়া। ফজরুন নেছার স্বামী চান মিয়া জালিয়াতি করে ভাগিনী থেকে তাকে মেয়ে বানিয়েছে। আমাকে স্বাক্ষীর জন্য নিয়েছিল কিন্তু আমি দেইনি। পরে সমাজসেবা অফিসার কাগজে আমার স্বাক্ষর নিয়েছেন। তাতে কি লেখা ছিল আমাকে পড়ে শুনানো হয়নি।
জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে ভূয়া জাতীয় পরিচয় পত্র নিকাহ নামা ও মায়ের জাল মৃত্যু সনদ ব্যবহার করে মেয়ে সেজে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা নিচ্ছেন ফজরুন নেছা। ২০২০ সালে আলমাছ আলীর ভাতিজা নাসির উদ্দীনের অভিযোগের ভিত্তিতে ফজরুন নেছার মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের ভাতা বন্ধ করা হয়। তখন ফজরুন নেছার এনআইডি কার্ডে পিতার নাম ছিল মোঃ তোতা মিয়া। ২০২০ সালে এনআইডি কার্ডে পিতার নাম পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেন ফজরুন নেছা। কিন্তু বিভাগীয় অফিস সেটা বাতিল করে দেয়। এরপর ২০২১ সালে আবারও পিতার নাম পরিবর্তনের জন্য আবেদন করলে সিলেট জেলা অফিস মোঃ তোতা মিয়া থেকে মোঃ আলমাছ আলীতে পরিবর্তন করে দেয়।
ফজরুন নেছা তার মাকে মৃত দাবি করলেও এলাকায় গিয়ে তার মা বড় বোন ও ২ ভাইকে খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়া ফজরুন নেছা তদন্ত কমিটির কাছে দেওয়া তার মা আসতুরা বেগমের মৃত্যু সনদে লিঙ্গ পুরুষ লেখা রয়েছে। এই মৃত্যু সনদ ইউনিয়ন পরিষদের সার্ভারে পাওয়া যায়নি। এসব ঘটনা মা আসতুরা বেগম জানার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ফজরুন নেছার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। ভাই মকবুল ও মখলিছ জানান ফজরুন নেছা আমাদের বোন। আর মুক্তিযোদ্ধা আলমাছ আলী আমাদের মামা। ফজরুনের স্বামী জালিয়াতি করে আমার মামাকে বোনের পিতা বানিয়েছে।
এলাকাবাসীর সুত্রে জানা যায়, ১৯৭৫ সালে আলমাছ আলী বিয়ে করেন মুমিনা বেগম নামে এক নারীকে। তাদের বিয়েতে উকিল (স্বাক্ষী) ছিলেন বিজয় পাড়ুয়া গ্রামের মখন মিয়া। বিয়ের ২ বছর পর আলমাছ আলী কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মারা যাওয়ার সময় তার কোন সন্তানাদি ছিল না। কয়েক বছর পর মুমিনা বেগমের দ্বিতীয় বিয়ে হয় পাশর্^বর্তী গোয়াইনঘাটের হাদারপাড় এলাকায়। মখন মিয়ার ছেলে শফিকুল ইসলাম জানান ১৯৯১ সালে আমি প্রবাসে যাই। তখনও মুমিনা বেগম তার দ্বিতীয় স্বামীকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। সে পর্যন্ত মুমিনা বেগমের কোন সন্তানাদি হয়নি। এছাড়া আলমাছ আলী ছিলেন আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা পাওয়ার আগ পর্যন্ত আলমাছ আলীর কোন মেয়ে ছিল বলে আমরা জানতে পারিনি।
এ বিষয়ে ফজরুন নেছার জানান, আমি বড় হয়েছি তোতা মিয়ার ঘরে। আমি জানতাম না যে আমার বাবা আলমাছ আলী। একদিন আমার চাচা খুরশিদ আলম আমাকে বলেন তোমার বাবা আলমাছ আলী। আর তোতা মিয়া তোমার পালিত বাবা। তাই এনআইডি কার্ডেও বাবার নাম তোতা মিয়া দেওয়া ছিল। পরে সেটা পরিবর্তন করে আলমাছ আলী করা হয়েছে।
ফজরুন নেছার মা আসতুরা বেগম বলেন আমি এই মেয়েকে জন্ম দিয়েছি কিন্তু টাকার জন্য মেয়ে আমাকে অস্বীকার করে। আমার ভাই আলমাছ আলীর কোন ছেলে মেয়ে নাই। জালিয়াতি করে ফজরুন নেছা আমার ভাইয়ের মেয়ে হয়েছে।