ইউনূসেই আস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর : শক্ত হাতে হাল ধরার আহ্বান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ মে ২০২৫, ২:৩০:২৮ অপরাহ্ন
২০২৬ এর ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচনে সবাই সন্তুষ্ট : প্রেস সচিব
জালালাবাদ রিপোর্ট : দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পদত্যাগের কথা ভেবেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে উপদেষ্টা পরিষদসহ ঘনিষ্টজনদের পরামর্শে তিনি সেই সিদ্ধান্ত পাল্টিয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এবার প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করছেন।
দ্বিতীয় দিনের সংলাপে রোববার (২৫ মে) বিভিন্ন দলের ২০ জনকে আমন্ত্রণ জানান নিজের বাসভবন যমুনায়। সেখানে দুইপর্বে বৈঠক হয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। প্রায় সবদলই ড. ইউনূসের প্রতি নিজেদের আস্থার কথা জানিয়েছেন। পদত্যাগের কথা চিন্তা না করে শক্ত হাতে হাল ধরার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় দুই দফায় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে নির্বাচন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানবিক করিডোর ইস্যুসহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে খোলামেলা আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে সেই আলোচনার কথা তুলে ধরেন।
ড. ইউনূস পরাজিত হলে আমরাও পরাজিত হবো- চরমোনাই পীর
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর) বলেছেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বলেছি, দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে আপনাকে নিয়ে এসেছিলাম একটি সুন্দর ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য। আপনার ওপর যে মানসিক নির্যাতন চলছে তা আমরা অনুভব করছি। রোববার (২৫ মে) যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব বলেন।
তিনি বলেন, আপনাকে সহজভাবে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না, এটাও আমাদের কাছে স্পষ্ট। আমরা উনাকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছি- আপনি যদি পরাজিত হন, তাহলে আমরাও পরাজিত হবো। কিন্তু মাঝপথে আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, এটা কোনোভাবেই হতে পারে না।
নির্বাচন প্রসঙ্গে চরমোনাই পীর বলেন, যদি প্রয়োজনীয় সংস্কার না হয়, তবে সামনে জাতীয় নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হবে। এতে আগের কলঙ্কিত নির্বাচনের ইতিহাস ফিরে আসবে যা আমরা কোনোভাবেই চাই না। তিনি জানান, স্থানীয় নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব ঠেকাতে তিনি সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে তিনি বলেন, কারও মতে ডিসেম্বর, আবার কেউ বলছেন মার্চ। তবে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন-২০২৬ সালের জুনের ৩১ তারিখের পরে তারা আর থাকবেন না। এতে আমাদের ভেতরে থাকা কিছু ভয় কেটে গেছে। শেষে চরমোনাই পীর বলেন, যেসব বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে অনুরোধ করেছি।
২৬-এর ৩০ জুনের পর এক ঘণ্টাও ক্ষমতায় থাকবেন না ইউনূস – মামুনুল হক :
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা তাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, যদি সবাই মিলে সহযোগিতা করি, তাহলে তিনি দেশ ও জাতিকে একটি গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করবেন।
তিনি বলেন, তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের কঠোরভাবে জানিয়েছেন- ২০২৬ সালের ৩০ জুনের পর এক ঘণ্টাও তিনি ক্ষমতায় থাকবেন না। এর আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করবেন এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে চান দেশ ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে।
তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে তিনটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বলেছি। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, সংস্কার নিয়ে এখনো সরকারের পক্ষ থেকে কাঙ্খিত কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। এটি একটি অনিশ্চিত পথে হাঁটা। তাই আমরা চাই সুনির্দিষ্ট লক্ষণ বা পদক্ষেপ নির্ধারণ।
শাপলা চত্বর ও অন্য হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার নিয়ে তিনি বলেন, শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে জুলাই বিপ্লব পর্যন্ত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম দৃশ্যমান হোক- এটা ছিল আমাদের দ্বিতীয় দাবি। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, খুব শিগগির এ বিষয়ে অগ্রগতি দেখা যাবে এবং একটি-দুটি হলেও বিচার দৃশ্যমান হবে।
রাজনৈতিক আলোচনা ও করিডোর ইস্যু নিয়ে তিনি বলেন, খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকে বলা হয়, করিডর বিষয়ে আমরা উদ্বেগ জানালে তিনি জানিয়েছেন, দেশবিরোধী কোনো কার্যক্রম তার দ্বারা সংঘটিত হবে না। যেকোনো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নারী সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন প্রসঙ্গে মামুনুল হক বলেন, নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথাও জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি আশ্বস্ত করেছেন-কোনো বিতর্কিত ইসলামবিরোধী আইন বাংলাদেশে কার্যকর হবে না।
নির্বাচনের সময় নির্ধারণের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি, নির্বাচন নিয়ে যেন বিভ্রান্তি না থাকে। সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করা হোক। উত্তরে তিনি বলেছেন-২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করা হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে সম্মানের জায়গায় নিতে চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদ আমাদের এ অর্জন মেনে নিতে পারছে না। পারলে একদিনে তা ধ্বংস করে দেবে। এটা যাতে কোনোভাবেই না হয়, সে জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, গেল কয়দিনের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার মন খারাপ ছিল। এজন্য তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মাঝ নদীতে মাঝি বদলাতে হয় না। এজন্য ড. ইউনূসের ওপর সবাই আস্থা রাখাতে চায়।
সাইফুল হক বলেন, অনেক ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার দলনিরপেক্ষ অবস্থা বজায় রাখতে পারছে না। এটি পরিহার করে নিরপেক্ষ আচরণ দেখতে চাই। এক সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার দেখতে চাই না। মানবিক করিডোরসহ জাতীয় কোনো সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া নেওয়া উচিত নয় বলে আমরা বৈঠকে জানিয়েছি।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ পাবেন না বলে ধারণা করেছিলেন। তাই তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। নির্বাচনের জন্য একটু শক্তিশালী প্রশাসন দরকার, সেটি প্রস্তুত হলেই নির্বাচন আয়োজন হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন।
মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বলেছি আপনি যদি দায়িত্ব ছেড়ে দেন এখন, তাহলে নির্বাচন, সংস্কার সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে যাবে। জাতি দিশেহারা হয়ে যাবে।
সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশে ও দেশের বাইরে থেকে গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মতের পার্থক্য থাকবে এটা মেনে নিতে হবে, কিন্তু কোনটা কার্যকর হবে সেটা ঠিক করবে জনগণ।
সেলিম বলেন, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে সংস্কার দরকার, তা করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সময়ক্ষেপণ করলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে, তখন কিছু করার থাকবে না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করেই তাকে (ড. ইউনূস) যেতে হবে। নানা ধরনের অনাস্থা তৈরি হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এই জায়গাটা দূর করতে হবে বলেও তিনি বৈঠকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জনগণ দৃশ্যমান বিচার দেখতে চায়। বিচারের আন্তর্জাতিক মান যাতে বজায় থাকে, সে ব্যাপারেও দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বৈঠকে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করেন সাকী। প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন, এটা যে জরুরী তা সরকারও মনে করে। তবে, নির্বাচনের জন্য যে পরিবেশ দরকার, যে প্রতিষ্ঠানগুলো জড়িত, সে প্রতিষ্ঠানগুলো যখন আত্মবিশ্বাসী হবেন যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তারা প্রস্তুত, তখনই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন।
৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচনে সবাই সন্তুষ্ট – প্রেস সচিব :
নির্বাচন ৩০ জুনের ওই পাড়ে যাবে না। এতে বিভিন্ন দলের নেতারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। রোববার (২৫ মে) রাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক শেষে এক বিফ্রিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।
প্রেস সচিব বলেন, পার্টির লিডাররা প্রফেসর ইউনূসকে সমর্থন জানিয়েছেন। আমরা যে সংস্কার করছি, আমরা যে বিচার কাজ শুরু করেছি, নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করেছি, সেটাতে তারা সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন।
শফিকুল আলম বলেন, আরও অনেকগুলো বিষয়ে কথা হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে, সংস্কারের বিষয়ে কথা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আবারও জানিয়েছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করবেন। ৩০ জুনের ওই পাড়ে যাবে না। এতে সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এর আগে চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান খুঁজতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিজের বাসভবন যমুনায় আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। বিভিন্ন দলের ২০ জন প্রতিনিধির সঙ্গে দুই দফায় বৈঠক করেন সরকারপ্রধান।
প্রথম দিনের সংলাপে শনিবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।