সিলেট সীমান্তে পুশইনে বাড়ছে উদ্বেগ : ১৮ দিনে পুশইন ৩১২
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ মে ২০২৫, ৫:০১:১৯ অপরাহ্ন
কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান নেতৃবৃন্দের
এমজেএইচ জামিল : সিলেট সীমান্তে অব্যাহত পুশ-ইনের ঘটনায় বাড়ছে উদ্বেগ। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে একের পর পুশ-ইন অব্যাহত রেখেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। বাংলাদেশী সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিবি) এর প্রতিবাদ ও সতর্ক অবস্থান স্বত্তেও থামছেনা পুশ-ইন।
গত ২৪ ঘন্টায় সিলেট সীমান্ত দিয়ে নতুন করে আরে ৪০ জনকে পুশ-ইন করেছে বিএসএফ। এর মধ্যে সোমবার (২৬ মে) সকাল পৌণে ৮টায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের মতেরবল সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় ২১ জনকে আটক করা হয়। আটককৃতদের মধ্যে ৭ জন পুরুষ, ৬ জন মহিলা ও ৮ জন শিশু রয়েছেন। আটককৃতরা বাংলাদেশি নাগরিক বলে বিজিবি নিশ্চিত করেছে।
এদিকে রোববার গভীর রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত চুনারুঘাটের কালেঙ্গা সীমান্ত থেকে আরো ১৯ জনকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
বিজিবির দাবি, বিএসএফ তাঁদের নিজ সীমান্তে একত্র করে কাঁটাতারের গেট খুলে এই নারী, পুরুষ ও শিশুদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ৫ শিশু, ৮ নারী ও ৬ পুরুষ আছেন। তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং কুড়িগ্রামের বাসিন্দা। তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তরের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হবে বলে বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সোমবার দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেন বিজিবি কালেঙ্গা ক্যাম্পের হাবিলদার জাকারিয়া।
তবে এই পুশ-ইন কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশীর নাগরিকের পাশাপাশি রুহিঙ্গা এবং ভারতীয়দের ঠেলে দেয়ার শঙ্কা করছেন খোদ বিজিবি কর্তৃপক্ষ। যদিও তারা জানিয়েছেন এব্যাপারে বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্কতার সহিত পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। কিন্তু মানবিক কারণে বিজিবি পুশ-ইন হওয়ার পর কাউকে ফের পুশ-ব্যাক করতে পারেনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট সীমান্ত দিয়ে একের পর এক শত শত মানুষকে পুশ-ইন (জোরপূর্বক ঢুকিয়ে দেওয়া) করছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। চলতি মাসের ৮ থেকে ২৬ মে পর্যন্ত ১৮ দিনে ৩১২ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে। এসব পুশ-ইন ঘটছে মৌলভীবাজার ও সিলেট সীমান্ত দিয়ে।
বিষয়টি নতুন করে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় সিলেট সীমান্তজুড়ে সতর্কতা ও তৎপরতা বাড়িয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তবুও থামছে না পুশ-ইন। এর আগে রোববার (২৫ মে) সিলেট ও মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়ে বড় ধরনের পুশ-ইন অর্থাৎ সর্বোচ্চ ১৫৩ জনকে পুশ-ইন করে বিএসএফ। তাদের বাড়ি দেশের বিভিন্ন জেলায় বলে বিজিবি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শনিবার (২৪ মে) গভীর রাত থেকে রোববার (২৫ মে) সকাল ৮টা পর্যন্ত পুশ-ইন করা হয়। তবে বাংলাদেশে প্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গেই তাদের আটক করেছে বিজিবি। এদের মধ্যে বড়লেখার লাতু বিওপি ক্যাম্প আটক করে ৭৯ জন, পাল্লাথল বিওপি ক্যাম্প আটক করে ৪২ জন ও নয়াগ্রাম বিওপি ক্যাম্প আটক করে ৩২ জনকে।
বিজিবি জানায়, ঘনজঙ্গল ও বিলের মধ্য দিয়ে তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়। বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মেহেদী হাসান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সীমান্তে পুশ-ব্যাক বা পুশ-ইন এমন একটা পদ্ধতি যেখানে ধরা পড়া ব্যক্তিদের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে অন্যদেশের সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়ে থাকে। ভারতের দিক থেকে যেটা পুশ-ব্যাক, বাংলাদেশের চোখে সেটাই পুশ-ইন। এই প্রক্রিয়ার কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই ভারতে। কিন্তু সম্প্রতি এভাবে শত শত বাংলাদেশীকে জোরপূর্বক সীমান্তে এনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, সীমান্ত পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠায় ভারতের মেঘালয়ের পূর্ব জৈন্তিয়া হিলস জেলাসহ তিনটি জেলায় আন্তর্জাতিক সীমান্তজুড়ে রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে ৫শ মিটার পর্যন্ত এলাকায় কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, গবাদিপশু পারাপার, অস্ত্র বা বিপজ্জনক বস্তু বহনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
তবুও থামছে না পুশ-ইনের মতো ঘটনা। সম্প্রতি সিলেট সীমান্তজুড়ে আরও বেড়েই চলছে এরকম বেআইনী কার্যক্রম।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ মে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ২১ বাংলাদেশিকে পুশ-ইন করেছে বিএসএফ। তাদের মধ্যে ১২ জন পুরুষ, চারজন নারী ও পাঁচজন শিশু ছিলেন। এর আগে গত ১৪ মে একই উপজেলার ডোনা সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে আরও ১৬ নারী-পুরুষকে পুশইন করা হয়। তাদের মধ্যে আটজন পুরুষ, ৬ জন নারী ও দুজন শিশু ছিলেন।
গত ২২ মে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া সীমান্ত দিয়ে শিশুসহ ৭ বাংলাদেশিকে পুশইন করেছে বিএসএফ। আটকদের মধ্যে ছিলেন দুইজন পুরুষ, দুইজন নারী ও তিন শিশু। তারা সবাই কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা।
গত ১৬ মে মৌলভীবাজারের বড়লেখার নিউ পাল্লাথল সীমান্ত এলাকা দিয়ে আরও ১৬ জনকে পুশইন করেছে বিএসএফ। এরমধ্যে ১৪ জন নারী ও দুজন পুরুষ ছিলেন।
গত ১৪ মে মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাল্লাতল সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশুসহ ৪৪ জনকে পুশইন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী ও ১৩ শিশু ছিলেন।
এর আগে গত ৮ মে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আরও ১৫ জনকে পুশইন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৯ জন পুরুষ, তিনজন নারী ও তিনজন শিশু ছিলেন।
এদিকে, সীমান্তে পুশ-ব্যাক ঠেকাতে তৎপর বিজিবি। গোয়াইনঘাটের খাসিয়া হাওড়, তামাবিল, সোনাটিলা, সংগ্রামপুঞ্জি, পান্তুমাই, বিছনাকান্দিসহ ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্টে টহল জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি।
বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মেহেদী হাসান, সীমান্ত এলাকার কিছু অংশ পাহাড়ি আবার কিছু এলাকায় জলাভূমি বিল থাকায় জিরো পয়েন্ট থেকে নজরদারি করা কঠিন। বিএসএফ তাদের এলাকায় স্থাপিত নিরাপত্তা লাইট বন্ধ করে দিয়ে মানুষদের সীমান্তের এপারে ঠেলে দেয়। পরে টহল বিজিবি তাদের আটক করে। বিজিবির হাতে আটকের পর পরিচয় যাচাই করে বাংলাদেশি নাগরিক বলে মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের পরিবারের কাছে পাঠানোর জন্য পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পুশ-ইন কিংবা পুশ-ব্যাক দুটিই বেআইনী – এড. এমাদুল্লাহ শাহীন :
সার্বিক বিষয়ে সিলেট জেলা বারের সাবেক সভাপতি ও সিলেট জজকোর্টের সাবেক পিপি এডভোকেট এমাদুল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, পুশ-ইন কিংবা পুশ-ব্যাক দুটিই বেআইনী এবং মানবাধিকার পরিপন্থী। সিলেট বিভাগ হচ্ছে সীমান্ত ঘেরা অঞ্চল। এই অঞ্চলে ভারত যেভাবে পুশইনের মাধ্যমে প্রতিদিন শত শত মানুষকে জোর করে ঠেলে দিচ্ছে তা কোনভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ক শুধু কড়া বিবৃতি নয়, কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনের আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সংগঠনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সীমান্তে উভয় দেশের মানুষ বন্দী হয়েছে। তখন দুটি দেশ তাদের মানুষকে আইনীভাবে হস্থান্তর ও গ্রহণ করেছে। এটাই সঠিক পদ্ধতি। বাংলাদেশী অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করলে সেদেশের আইন অনুযায়ী বাংলাদেশী দুতাবাসকে বিষয়টি অবহিত করতে হবে। দুতাবাসের মাধ্যমেই তাদেরকে দেশে পাঠাতে হবে। এভাবে বাংলাদেশী বলে শত শত মানুষকে পুশ-ইন করা কোনভাবেই সঠিক নয়। বিষয়টি উভয় দেশের জন্য বিপজ্জনক। তাই এখনি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সবকিছুর উর্ধ্বে – জিকে গউছ :
বিএনপির কেন্দ্রীয় সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জি কে গউছ দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমাদের দেশ যেমন আইন-কানুন মেনে চলে, তেমনী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতও আইন কানুন মেনে চলে। তাই আমাদের কোন নাগরিক তাদের দেশে গেলে আইনীভাবে হস্তান্তর করতে হবে। তা না করে ভারত যেভাবে জোরপূর্বক পুশ-ইন করছে তা অনাকাঙ্খিত এবং দুই দেশের ভাবমূর্তি ও সম্পর্কে জন্য ক্ষতিকর। এ ব্যাপারে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সতর্ক থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালিন সরকারকেও বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সবকিছুর উর্ধ্বে।
কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল – এড. জুবায়ের :
জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল সিলেট অঞ্চলের পরিচালক এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, জামায়াত কেন্দ্রীয়ভাবে পুশইন বন্ধ করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এই ধরণের আইন ও মানবাধিকার পরিপন্থী দুইদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল। এই ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালিন সরকারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। পুশ-ইনের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার ব্যাপারে দেশপ্রেমিক জনতাকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং পুশ-ইন করাদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে সরকারসহ দেশবাসীকে স্বোচ্ছার হতে হবে।
রুহিঙ্গা প্রবেশের শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা – ৪৮ বিজিবি অধিনায়ক :
সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. নাজমুল হক দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, ৪৮ বিজিবির আওতাধীন এলাকা দিয়ে এখনও পুশ-ইন-পুশ-ব্যাকের ঘটনা ঘটেনি। তবুও সীমান্তজুড়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে এ বিষয়ে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। যাতে সীমান্তে এ ধরণের অপৎপরতার খবর পেলেই বিজিবিকে জানাতে পারেন। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, পুশ-ইনের পর কাউকে ফের পুশ-ব্যাক করাও বেআইনী। বিজিবি পুশ-ইন হওয়াদের আটক করে পরিচয় নিশ্চিতের চেষ্টা করে। অনেকের কাছে পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। আবার অনেকেই বলেন কয়েক বছর আগে গিয়েছেন পরিচয় পত্র নেই। তখন তাদেরকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। এতে বাংলাদেশীদের পাশাপাশি রুহিঙ্গা প্রবেশের শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা। রুহিঙ্গারা দুই ধরণের কেউ আমাদের দেশের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে সে দেশে গেছে আবার কেউ কেউ মিয়ানমার থেকে ভারতে এসেছে। এসব রুহিঙ্গাদের এত দ্রুত আইডেন্টিফাই করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপরও বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।