মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিময় হারের ধাক্কা অর্থনীতিতে চাপ বাড়াবে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০২৫, ৭:৪১:০১ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক : মন্ত্রণালয়ের মিডিয়াম-টার্ম ম্যাক্রোইকোনমিক পলিসি স্টেটমেন্ট (এমটিএমপিএস) বা মধ্যমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু হলে ডলারের দাম বেড়ে যেতে পারে। এতে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে—যা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কৃচ্ছ্রসাধন নীতি বজায় রাখার পাশাপাশি, আসন্ন অর্থবছরে সরকারকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার বাস্তবায়নেও পদক্ষেপ নিতে হবে—যা আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত হিসেবে রাখা হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মিডিয়াম-টার্ম ম্যাক্রোইকোনমিক পলিসি স্টেটমেন্ট (এমটিএমপিএস) বা মধ্যমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু হলে ডলারের দাম বেড়ে যেতে পারে। এতে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে—যা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপলক্ষে দেশ ও বর্হিবিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি এবং আগামী দুই অর্থবছরজুড়ে পরিস্থিতি কেমন থাকতে পারে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে ২০২৫-২৬ থেকে ২০২৭-২৮ সময়ের জন্য এই স্টেটমেন্ট প্রণয়ন করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিভাগের কর্মকর্তারা।
স্টেটমেন্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, বহির্বিশ্বের আর্থিক ঝুঁকি এবং এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের প্রক্রিয়া রপ্তানি খাতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমলেও, এতে রাজস্ব আয় হ্রাস এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি কমার আশঙ্কা রয়েছে বলেও সতর্ক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে দুটি স্বতন্ত্র সংস্থায় ভাগ করতে পারলে আগামী তিন বছরের মধ্যে রাজস্ব আয় দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে।
“বাংলাদেশের জন্য আগামী বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ”, বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, “এক্সচেঞ্জ রেট বেড়ে গেলে বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে সরকারের বাড়তি অর্থ ব্যয় হবে, খাদ্য ভর্তুকিসহ অন্যান্য ভর্তুকিও বাড়বে—যা ফিজক্যাল প্রেসার তৈরি করবে। তবে রপ্তানি কমে গেলে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক নাও হতে পারে।”
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বার্ষিক উন্নয়নে বরাদ্দ কমানোর পাশাপাশি নতুন অর্থবছরও বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি কেনা এবং রাষ্ট্রীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করা হবে জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আগামী অর্থবছরও যথাসম্ভব বাহুল্য কোনো খরচ করবো না। গত ৮ মাসে আমরা গাড়ি কেনার মতো সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছি; অনুষ্ঠান করা, দেশের বাইরে যাওয়াও কমিয়েছি। এগুলো আমরা কন্টিনিউ করবো।”
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি হ্রাসের সম্ভাবনা নিয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “রপ্তানি কমলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সহায়তা হতে পারে, তবে এটা সবসময়ের জন্য ইতিবাচক নয়। রপ্তানি কমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে। ফলে বিনিময় হার আরও বেড়ে যেতে পারে, যা উল্টো মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে পারে।”
স্টেটমেন্টে সম্প্রসারিত রাজস্ব ঝুঁকি মূল্যায়নের অংশ হিসেবে আর্থিক ঝুঁকি, বহির্বিশ্বের আর্থিক আঘাত, সম্ভাব্য দায়বদ্ধতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে এতে দেশের চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রস্তাবিত সংস্কার কর্মসূচি এবং অর্থনীতিতে সেগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি?
অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্টেটমেন্টে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের অর্থনীতি কাঠামোগত ও নীতিগত দিক দিয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এতে বলা হয়েছে, ‘বাস্তব জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধীরে ধীরে বাড়বে—২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫ শতাংশ থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৫.৫ শতাংশ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এটি ৬.৫ শতাংশে পৌঁছাবে।’ এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কঠোর মুদ্রানীতি এবং সতর্ক রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কারণে গড় মুদ্রাস্ফীতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৯ শতাংশ থেকে ৬.৫ শতাংশ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৫.৫ শতাংশে নেমে আসবে।’ স্টেটমেন্টে আরও বলা হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিময় হার সংক্রান্ত ধাক্কা সাধারণত রাজস্ব খাতে চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, রপ্তানি হ্রাসের মতো বহির্বিশ্বের আঘাত মুদ্রাস্ফীতির চাপ কিছুটা কমাতে পারে, তবে এতে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, “মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আমরা আশা করছি, আগামী অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারব।” এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পরিকল্পনা হলো, চাহিদা কমানোর পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, তা অর্জন করা সম্ভব—তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে হবে।
বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগের পরও দেশের মুদ্রাস্ফীতি ২৬ মাস ধরে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নেমেছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৯.১৭ শতাংশ।
এনবিআর পুনর্গঠন করলে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়তে পারে
আসন্ন অর্থবছরে রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপের মুখে রয়েছে সরকার। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের ঋণের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে এনবিআরকে দুই ভাগে (কর নীতি বিভাগ ও কর প্রশাসন বিভাগ) ভাগ করার জন্য সরকার অধ্যাদেশ জারি করেছে। তবে এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন এনবিআর কর্মকর্তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ধারণা, এনবিআরকে দুই বিভাগে বিভক্ত করা হলে দেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো সম্ভব হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও কর আদায় সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হচ্ছে। এ অবস্থায় কয়েকটি সংস্কার উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে—কর নীতিকে কর প্রশাসন থেকে আলাদা করা, কর পরিশোধের প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণ, কর অঞ্চলের সম্প্রসারণ এবং কর অব্যাহতির পরিমাণ কমানো।
আরও বলা হয়েছে, ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ৮.৩৭ শতাংশ হতে পারে। এছাড়া মধ্যমেয়াদে গড় রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ১০.৪ শতাংশ।’
২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে বাজেট ঘাটতি কমে আসবে। অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মধ্যমেয়াদে সরকার আর্থিক সংহতিকরণের (ফিস্ক্যাল কন্সোলিডেশন) নীতি অনুসরণ করছে এবং এক্ষেত্রে জরুরি উন্নয়ন খরচকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। স্টেটমেন্টে বলা হয়েছে, ‘উপলব্ধ সম্পদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে মোট ব্যয় যুক্তিসঙ্গত করা হচ্ছে। বাজেট ঘাটতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৪.৬ শতাংশ থেকে কমে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩.৬ শতাংশে নেমে আসার আশা করা হচ্ছে।’ এছাড়া বলা হয়েছে, ‘সাবধানতার সঙ্গে ঋণগ্রহণ এবং কার্যকর ঋণ ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৩৭ শতাংশে স্থিতিশীল থাকবে।’
বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব এখনও কাটিয়ে উঠতে না পারা, কঠোর মুদ্রানীতি এবং বিশ্বজুড়ে দীর্ঘস্থায়ী ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি এখনো নানা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘এই সকল কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীরগতিতে এগোচ্ছে, পণ্য ও জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা বেড়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপও ক্রমশ বাড়ছে।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, ‘এই পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক (ম্যাক্রোইকোনমিক) সমন্বয়ের সময় পার করছে।