অক্ষতাই প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার মূল কারণ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ মে ২০২৫, ৮:০৯:২৯ অপরাহ্ন
মেধাবী মানেই দক্ষ নন
জালালাবাদ ডেস্ক: বেশ কিছুদিন ধরেই সরকারের প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। দাবি, আন্দোলনও হচ্ছে অনেক জায়গায়। এমনকী প্রশাসনের নাভী সচিবালয়ও বাদ যাচ্ছেনা। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা এজন্য সরকারের প্রশাসনের নেতৃত্বের অদক্ষতা ও ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন। তারা বলছেন ফ্যাসিস্টের পতনের পর প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা মেধাবী কিন্তু দক্ষ নন। অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দ পদায়নে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাকে পদায়ন করা হয়েছে তিনি সেই পদের জন্য অভিজ্ঞ এবং দক্ষ কিনা তা বিবেচনা করা হয়নি।
ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় ১০ মাস হতে চললেও এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি প্রশাসনে। বরং এখন বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করেছে। চতুর্মুখী দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে বিপর্যস্ত প্রশাসন। প্রশাসন এখন অনেকটাই স্থবির। সঠিকভাবে সেবা পাচ্ছেন না নাগরিকরা।
‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে গত শনিবার থেকে প্রায় টানা আন্দোলনে রয়েছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতিসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছেন বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলারা জানিয়েছেন, যেখানে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে প্রশাসন ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে যাবে, সেখানে উল্টো অরাজকতা আরও বেড়েছে। প্রায় দশ মাসে প্রশাসনকে কাক্সিক্ষত জায়গায় নিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।
প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারেনি সরকার। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। মূলত নেতৃত্বের দুর্বলতায় প্রশাসনে স্থিতিশীলতা আসার পরিবর্তে অরাজকতা বেড়েছে বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। তখন প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো থেকে আগের সরকারের নিয়োগ দেওয়া প্রায় সব কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে নজিরবিহীন অরাজকতা সৃষ্টি হয় প্রশাসনে। এরপর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা প্রথম দিকের বিশৃঙ্খলাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘সরকার প্রথম শীর্ষ পদগুলোতে বাছাই করে নিজের পছন্দের লোক বসিয়েছে, এটাই সরকারের ভুল হয়েছে। আসলে দেখা উচিত ছিল দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোক। এই ধরনের লোকদের শীর্ষ পদে বসানো উচিত ছিল। এটা না করাতে এবং নিজেদের পছন্দের লোক বসানোর কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য তারা প্রশাসনের সংকটটা সামাল দিতে না পেরে আরও জটিল করে তুলেছে।’
তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর তো প্রশাসন ভঙ্গুর ছিল। ভঙ্গুর প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর জন্য যে ধরনের দক্ষ, যোগ্য এবং অভিজ্ঞ শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রয়োজন ছিল, সেক্ষেত্রে বাছাই করে নিয়োগ দিতে ভুল করেছে সরকার। সরকার ব্যক্তিগত পছন্দের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছিল।’
‘যেহেতু এদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা নেই, সবচেয়ে বড় কথা এদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো তেমন গুণাবলি নেই। যে কারণে এরা নিজেরাই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে এবং ভীত অবস্থায় ছিল। যারা একটু কম দক্ষ, অভিজ্ঞ হয় তারা সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে, ভুল করে, অন্যের ওপর নির্ভর করে। তারা প্রতিনিয়ত এই ভুলগুলো করে গেছে।’
সাবেক আমলা ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, ‘প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের সঠিক পরামর্শ দিতে পারেননি। তারা দিয়েছেন ভুল পরামর্শ। যাদের নেওয়া হয়েছে তারা মেধাবী হতে পারেন, কিন্তু প্রশাসন বিষয়ে তারা দক্ষ নন এবং প্রশাসনিক নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণাবলি তাদের নেই। প্রশাসনিক সক্ষমতা, দক্ষতা ও জ্ঞান তাদের নেই। সেই কারণে আস্তে আস্তে প্রশাসনে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন আরেকটি বিপর্যয় ডেকে এনেছে- মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এ কমিশন কতগুলো বিতর্কিত কাজ করেছে। তারা সংস্কার করবে এমন সব বিষয়- যার মাধ্যমে কীভাবে জনস্বার্থ রক্ষা হবে, জনগণ কীভাবে আরও বেশি সেবা পাবে। তারা জনস্বার্থের বিষয়গুলোর দিকে না গিয়ে কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে গেছে। সেটা করতে গিয়ে তারা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। তারা বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও তীব্র করে তুলেছেন। ক্যাডার, নন ক্যাডার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। সব জায়গায় একটা বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো সক্ষমতা বর্তমান সরকারের নেই।’
‘যারা কর্মকর্তা রয়েছেন তারা সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাচ্ছেন। মনে করছেন, কোনো সিদ্ধান্ত নিলে কী বিপদে পড়বো। এই যে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে থেকে দাবি-দাওয়া জানানো হচ্ছে। তাদের সঙ্গে বার্গেনিং করে তাদের নিউট্রালাইজ করা, সেই সক্ষমতা তো দেখতে পাচ্ছি না।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা তাদের (শীর্ষ কর্মকর্তা) দক্ষতা যোগ্যতা সম্পর্কে জেনে গেছেন। সেজন্য এদের আর পাত্তা দিচ্ছেন না। তারা একটা শুদ্ধ আদেশও জারি করতে পারছেন না। আদেশ জারি করে তা বাতিল করার ঘটনা অহরহই ঘটছে।’
নিরপেক্ষ ও দক্ষ লোকদের দিয়ে প্রশাসন সাজানোর পরামর্শ দিয়ে ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘আগে যারা দলীয় মার্কামারা ছিলেন, তাদের আপনি নিবেন, এনজিওতে কাজ করেছেন, নিজেদের পরিচিত ছিলেন তাদের নেবেন, তাহলে তো অবস্থা এমন হবেই। দক্ষ, যোগ্য, নিরপেক্ষ সাহসী লোক যারা জনপ্রশাসন বুঝে এমন লোক তো তারা নিচ্ছেন না।’
‘আবার সবাই যে খারাপ করছে প্রশাসনে, সেটাও না। কিন্তু তাতে তো কাজ হচ্ছে না। পুরো জনপ্রশাসন একটা স্পিরিট নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এক জায়গায় দুর্বলতা দেখা দিলে তো সেটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এখনো অনেক পদশূন্য রয়েছে। এতদিন পদ কেন শূন্য থাকবে?’
নাম প্রকাশ না করে সচিবালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে। যখন একটা হযবরল অবস্থা, ওই সময় কেন সরকারকে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ করতে হবে। এটি সব পর্যায়ের কর্মচারীদের ক্ষুব্ধ করেছে। কারণ আইনটি নিবর্তনমূলক। এটির অপব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি ও সাবেক সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের অব্যাহতভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছেন এবং জনপ্রশাসনকে দক্ষতা ও সুচারুভাবে পরিচালিত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও জনপ্রশাসন সচিবের অপসারণের দাবি জানিয়েছি আমরা। তাদের অপসারণের দাবি উত্থাপন করে প্রধান উপদেষ্টা, সব সংস্থা, অধিদপ্তর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি পালন করছি।’