গণঅভ্যুত্থানের বুলেটের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন জকিগঞ্জের কামিল
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মে ২০২৫, ৯:২২:২০ অপরাহ্ন
এখলাছুর রহমান, জকিগঞ্জ : গণঅভ্যুত্থানের সময় সিলেটের গোলাপগঞ্জে ছাত্র-জনতার সঙ্গে আন্দোলনে নেমে পুলিশের ছোঁড়া রাবার বুলেটে জকিগঞ্জের কামিল আহমদ (২৫) নামের এক গাড়ি চালক কাজকর্ম করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। গুলির ক্ষত আর যন্ত্রণা নিয়ে ওই যুবক বিছানায় পড়ে থাকলেও কেউ খোঁজখবর নিচ্ছেন না। অর্থের অভাবে চিকিৎসা বন্ধ হওয়ায় পরিবারের লোকজন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সরকারি গেজেটেও হয়নি তার স্থান। সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে রয়েছেন বঞ্চিত।
দুর্ভাগা ওই জুলাইযোদ্ধা জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল ইউপির খিলগ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে। ৩ ভাই আর ২ বোনের মধ্যে গুলিবিদ্ধ গাড়ি চালক কামিল দ্বিতীয়। টানাপোড়েনের সংসারে তিনি ছিলেন অর্থের অন্যতম যোগানদাতা। খরচ জুটাতেন গাড়ি চালিয়ে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনে অংশ নিয়ে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়ে এখন চিকিৎসা ছাড়াই বাড়িতে চরম কষ্টে দিন পার করছেন।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে হত্যার পর থেকেই গাড়ি চালক কামিল আহমদ সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের মাঠে ছিলেন। ৪ আগস্ট বিকেলে কার নিয়ে গোলাপগঞ্জে যান কামিল। সেখানে পৌঁছার পর দেখতে পান ছাত্র জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছে। তখন তিনিও ছাত্র-জনতার সঙ্গে লাঠি হাতে নিয়ে রাজপথে প্রতিরোধে অংশ নেন। একপর্যায়ে পুলিশ ছাত্র জনতাকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি রাবার বুলেট ছোঁড়লে গাড়িচালক কামিল আহমদ বুলেটবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে দ্রুত সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে পাঠান। চিকিৎসকরা দায়সারাভাবে তার শরীর থেকে ১৬ টি রাবার বুলেটের কিছু অংশবিশেষ বের করে ভয়ভীতি দেখিয়ে উন্নত চিকিৎসা ছাড়াই বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তখন গ্রেফতার আতঙ্কে আহত কামিল আহমদও উন্নত চিকিৎসার জন্য জোর জবরদস্তি করেননি। পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে বাড়িতে চলে আসেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কামিল সুচিকিৎসার আশা নিয়ে আবারও চিকিৎসকের কাছে যান। তখন চিকিৎসকরা জানান, অপারেশন করে রাবার বুলেটের অংশ শরীর থেকে বের করতে হবে। অপারেশন ছাড়া পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবেন না। তাতে বড় অঙ্কের টাকা খরচ লাগবে। তখন কামিলের পরিবারের লোকজন ধার-দেনা করে কয়েকদিন তার চিকিৎসা খরচ চালিয়ে যান। কিন্তু টাকার অভাবে অপারেশন করানো সম্ভব হয়নি। এতে খুবই হতাশ কামিলের মা-বাবাসহ পরিবারের লোকজন। বুধবার (২৮ মে) জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হওয়া গাড়ি চালক কামিল আহমদের বাড়িতে গেলে তার পরিবারের লোকজন আক্ষেপের সুরে এমন আদ্যোপান্ত জানান।
এ সময় আহত কামিলের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আবু সাঈদকে হত্যার পর থেকেই সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের মাঠে ছিলাম। ৪ আগস্ট গোলাপগঞ্জে গাড়ি মেরামত করাতে যাই। তখন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হলে আমিও লাঠিসোটা নিয়ে যোগ দেই। হঠাৎ করেই পুলিশ এলোপাতাড়ি রাবার বুলেট ছুঁড়তে থাকে। আমি তখন বুলেটবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। স্থানীয়রা আমাকে উদ্ধার করে সিলেট সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠালে চিকিৎসকরা নামেমাত্র চিকিৎসা দিয়ে পুলিশ গ্রেফতার করবে এমন ভয়ভীতি দেখিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর নির্ভয়ে চিকিৎসা করাতে যাই। তখন চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার কথা বলেন এবং জানান বড় অঙ্কের টাকা খরচ করতে হবে। আমার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকায় সেটা পারিনি। শরীরে রাবার বুলেটের কিছু অংশ এখনো রয়ে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। প্রচন্ড ব্যথায় ভালোভাবে ঘুমাতে পারিনা। চোখ দিয়ে অবিরাম পানি ঝরছে। গাড়ি চালাতে পারিনা। আত্মীয় স্বজনের সাহায্যে চলছে পরিবার।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, জুলাই আন্দোলনে অনেকজন সামান্য আহত হয়েও লবিং শক্ত থাকায় সরকারের গেজেটভুক্ত হয়েছেন। নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে সকল প্রকার সহযোগিতা নিচ্ছেন। কিন্তু আমি ১৬টি রাবার বুলেটে আহত হয়ে যন্ত্রণায় দিন কাটালেও সরকারি সহযোগিতা কিংবা গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
আহত কামিলের বাবা আব্দুর রহিম জানান, গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে শামিল হয়ে আমার ছেলে ১৬টি বুলেটে বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সুচিকিৎসার অভাবে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের ৯ মাস পর্যন্ত ছটফট করছে। ছেলেটা আহত হওয়ার পর থেকে গাড়ি চালানোর সক্ষমতা হারিয়ে বাড়িতে শুয়ে থাকে। ক্ষতের যন্ত্রণা শুরু হলে চিৎকার করে কান্নাকাটি করে। তিনি বলেন, আমার পরিবারের অর্থের অন্যতম যোগানদাতা ছেলের সুচিকিৎসা নিশ্চিত ও আহতদের সরকারি গেজেটে নাম সংযুক্ত করতে সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, তাঁকে দ্রুত জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করতে বলেন।