লন্ডনে ইউনুস-তারেক বৈঠক কাল : রাজনীতিতে নতুন ডাইমেনশন
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুন ২০২৫, ১:৫৯:৩৭ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট :
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বৈঠক হতে যাচ্ছে আগামীকাল শুক্রবার। লন্ডনের স্থানীয় সময় সকালে এই হাই ‘প্রোফাইলস’ বৈঠকটি হবে বলে সরকার ও বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। জামায়াতও বৈঠকটি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে। এ বৈঠক রাজনীতিতে নতুন ডাইমেনশন বা মাত্রা যোগ করতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমন এক সময়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সাথে বিএনপির শীর্ষ নেতার এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন আগামী জাতীয় নির্বাচনসহ বেশ কিছু ইস্যুতে বিএনপি ও সরকারের টানাপোড়েন চলছে।
এখন দেশের রাজনীতি-সচেতন সবার দৃষ্টি লন্ডনের এই বৈঠকের দিকে। বৈঠকে ভোটের দিনক্ষণ, সংস্কার, জুলাই সনদসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে কী বোঝাপড়া হয়, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তারেক রহমানের সাথে যুক্তরাজ্য সফরে অধ্যাপক ইউনূসের বৈঠকের বিষয়ে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে যোগাযোগও করা হয়।
রাজনৈতিক মহল এই সাক্ষাৎকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাৎ ফলপ্রসূ হলে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং জুলাই সনদসহ আরও অনেক বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির যে দূরত্ব বা মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কমে আসতে পারে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, গত মে মাসের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরের সময় চূড়ান্ত হয়। বিষয়টি জানার পর তখন থেকেই বিএনপি বিবেচনায় রেখেছিল; প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সৌজন্য সাক্ষাৎ হতে পারে কি না।
এরই মধ্যে আদালতের রায় আসার পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানো, এটাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে রাজধানীতে অচলাবস্থা তৈরি, এর রেশ ধরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) সঙ্গে বিরোধে জড়ানোসহ সরকারের সঙ্গে একধরনের তিক্ততা তৈরি হয়। এমন একটা পরিস্থিতিতে ২৮ মে নয়াপল্টনে বড় সমাবেশ ডেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে বলে তারেক রহমান জোর দাবি জানান।
এরপর প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেন; তাতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব সন্তুষ্ট হতে পারেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লন্ডনে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের সম্ভাব্য সৌজন্য সাক্ষাতের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এই সাক্ষাৎ যাতে হয়, এ ব্যাপারে সর্বশেষ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও ভূমিকা রাখেন। পরে দুই পক্ষের ইচ্ছায়, বিশেষ করে সরকারের দিক থেকে বাড়তি আগ্রহে সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ হয়। এ বিষয়ে গত সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়। তাঁরা এই সাক্ষাৎকে দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য হিতকর হবে বলে মনে করেন।
মঙ্গলবার সকালে গণমাধ্যমের সাথে অনানুষ্ঠানিক এক ব্রিফিংয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, প্রধান উপদেষ্টার সাথে তারেক রহমানের এই বৈঠকে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি বড় ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হতে পারে। সেই সাথে নতুন ডাইমেনশন সৃষ্টি হতে পারে, অনেক সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে তিনি মনে করছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। তিনি একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৭ বছর ধরে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত রয়েছেন। আমরা মনে করি, সরকারের প্রধান ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎটা হওয়া উচিত এবং এটা রাজনৈতিক শিষ্টাচারেরও অংশ। এই সাক্ষাৎ না হলে নিন্দুকেরা বিরূপ সমালোচনার সুযোগ নিতে পারত।
লন্ডনে অনুষ্ঠেয় এই সাক্ষাৎ নিয়ে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যেও কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, এটাকে (সাক্ষাৎ) আমরা
ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের প্রধানের সঙ্গে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের ফাংশনাল প্রধানের সাক্ষাৎ হচ্ছে। আমরা আশা করি, আগামী জাতীয় নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়ে তাঁরা কথা বলবেন।
অবশ্য জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি দল প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়কে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলেছে, এতে জাতি আশ্বস্ত হয়েছে।
এর মধ্যে জামায়াত ও এনসিপি মনে করে, জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার পর নির্বাচনের সময় ঘোষণা করা হলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হতো। জামায়াত আশা করে, সংস্কার, বিচার (আওয়ামী লীগের) ও নির্বাচন-এ তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে এবং ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশকে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
‘রাজপথে নয়, টেবিলে সমাধানের পরামর্শ’ :
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে এ লক্ষ্যে আগামী জুলাই থেকে মাঠের কর্মসূচিরও পরিকল্পনা করছিল বিএনপি। কিন্তু সে অবস্থান থেকে আপাতত কিছুটা সরে আসার ইঙ্গিত দিচ্ছেন নেতারা।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, এ ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভূমিকা রাখেন। খালেদা জিয়াকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে ৭ জুন রাতে তাঁর বাসভবনে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। তখন তিনি জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাছে জানতে চান, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে এত দূরত্ব তৈরি করা হলো কেন। তিনি নেতাদের উদ্দেশে বলেন, এই সময়ে কোনো বিষয় নিয়ে রাজপথে যাওয়া ঠিক হবে না। যত সমস্যাই থাকুক, আলোচনায় বসে সমাধান করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির নেতাদের এই সাক্ষাতের পরদিন রোববার খালেদা জিয়া তাঁর বড় ছেলে ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরই সোমবার রাতে স্থায়ী কমিটির সভা হয়। এই সভা থেকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সৌজন্য সাক্ষাৎকে স্বাগত জানানো হয়। বিএনপির নেতারা মনে করেন, এই সাক্ষাৎ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট কাটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ প্রস্তুত করতে সহায়ক হতে পারে।