এবারও চামড়ায় হতাশা!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুন ২০২৫, ৫:০০:১৫ অপরাহ্ন
ন্যায্যমূল্য পাননি কোরবানীদাতা ও ব্যবসায়ী
এমজেএইচ জামিল : এবারের ঈদুল আজহায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর চামড়ার বর্ধিত নতুন দাম নির্ধারণ করে দিলেও নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হয়নি বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, মূল সমস্যা সমাধান না করে চামড়ার দাম বাড়ালেই বাজার চাঙ্গা হবে না।
এদিকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চামড়াজাত পণ্যের দাম কয়েকগুণ বাড়লেও দিন দিন কমছে চামড়ার মূল্য। গেল কয়েক বছর ধরে নায্যমূল্য না পাওয়ায় কুরবানীর পশুর চামড়া পানিতে ফেলতে ও মাটিতে পুতে ফেলতে দেখা গেছে। এবারো সেই রকম না হলেও সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্য মুল্য মিলেনি চামড়ার। সিন্ডিকেটের কারণে অতীতের ন্যায় এবারও ধরাশায়ী হয়েছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট নগরীতে এবারও কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি হয়েঠে ১০০ ও ১৫০ টাকা দরে। এছাড়া সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত চামড়া বিক্রি হয়েছে বলেও জানা গেছে। ঈদের দিন সকাল থেকে যারা কুরবানী দিয়েছেন তারা কম দামে ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া বিক্রি করেছেন। এবারও কোরবানির গরুর চামড়ার দাম না পাওয়ায় অনেকেই ফেলে দেন ও কম মূল্যে বিক্রি করতে দেখা যায়।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় এক লক্ষ্য টাকা দিয়ে যে গরু কিনেছেন সেই গরুর চামড়া দেড়শ টাকা দিয়ে বিক্রি করেছেন অনেকেই। আবার মূল্য কম হওয়ায় অনেকেই চামড়াটি মাদ্রাসায় দিয়ে এসেছেন। কোরবানি দেওয়া অনেকেই জানান এবারও চামড়ার দাম নেই ১০০ ও ১৫০ টাকার উপরে বিক্রি করা যায়নি। স্থান ও পশুর দাম ভেদে কিছু চামড়া ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। আর এটাই ছিল এই ঈদের সর্বোচ্চ চামড়ার মূল্য।
এদিকে এবারও চামড়া ব্যবসায়ীদের মুখে উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা দেখা গেছে। কারণ, প্রতিবছরের মতো এবারও ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়ার অভিযোগ তুলছেন খোদ ব্যবসায়ীরা।
সিলেটের একাধিক চামড়া ব্যবসায়ীর সাথে আলাপকালে জানা গেছে, এবারও কুরবানীর পশুর চামড়ার দাম কম, তাই ১০০ ও ১৫০ টাকা দিয়ে আমরা চামড়া কিনেছি। কিছু ক্ষেত্রে ৪০০ টাকা দিয়েও কেনা হয়েছে। এর উপরে কিনলে আমাদের লোকসান হতো। কারণ ১৫০ টাকা দিয়ে যে চামড়া কিনেছি সেই চামড়া ২০০ টাকার উপরে বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু প্রতি বছর সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, আমরা সেই দামে বিক্রি করতে পারি না। লবণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ তুলতেই হিমশিম খেতে হয়। গত কয়েক বছর ধরে লোকসান গুণেই টিকে আছি।
তারা আরও বলেন, সিলেট জেলায় আগে ৪০০-৫০০ জন ব্যবসায়ী ছিলেন, এখন আছে মাত্র ৬০-৭০ জন। বাকিরা ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে এখনও গত কয়েক বছর আগের চামড়ার টাকা বকেয়া পড়ে আছে। চামড়ার বাজারে এই অনিশ্চয়তা নতুন নয়। প্রতি বছর ঈদে পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হলেও ট্যানারিতে বিক্রির সময় দাম কমে যায় আশঙ্কাজনক হারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগের ৪ জেলার মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে এ বছর কোরবানির ২ লাখ ৯ হাজার ৩৪৫ টি গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে, গরু ও মহিষের চামড়া সংখ্যা ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৪৫টি। আর ছাগলের চামড়ার সংখ্যা ২২ হাজার। সিলেট বিভাগ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোল রুমে পাঠানো তথ্য থেকে এ চিত্র দেখা গেছে।
জেলাগুলোর মধ্যে সিলেটে সংরক্ষণ করা চামড়ার সংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার ৩৫০টি। এর মধ্যে গরু ও মহিষের চামড়া ৯৭ হাজার ৮৫০টি এবং ১২ হাজার ৫০০টি ছাগলের চামড়া। সুনামগঞ্জে ১৭ হাজার ৩০০টি চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর সবগুলো গরুর চামড়া।
বাকি দুই জেলার মধ্যে হবিগঞ্জে ৩২ হাজার ৭০টি চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর সবগুলো গরুর চামড়া। আর মৌলভীবাজারে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৪৯ হাজার ৬২৫টি চামড়া। এর মধ্যে ৪০ হাজার ১২৫টি গরুর চামড়া এবং ৯ হাজার ৫০০টি ছাগলের চামড়া রয়েছে।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের তদারকিতে এসব চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে সরকার সরবরাহ করা বিনামূল্যের লবণ দিয়ে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, এ বছর কোরবানির চামড়ার মূল্যবৃদ্ধি এবং এতিমদের হক আদায়ের উদ্দেশে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের এতিমখানা, মসজিদ ও মাদরাসাগুলোতে বিনামূল্যে ৩০ হাজার মেট্রিক টন লবণ সরবারহ করা হয়। যাতে করে স্থানীয়ভাবে দুই থেকে তিন মাস চামড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন দর অনুযায়ী, এ বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।
ট্যানারির হিসাব অনুযায়ী, ৩০ বর্গফুট কিংবা এর চেয়ে বেশি আকারের চামড়াকে বড়, ২০ বর্গফুটের ওপরের চামড়াকে মাঝারি এবং ২০ বর্গফুটের নিচের চামড়াকে ছোট চামড়া হিসেবে ধরা হয়।
এ হিসাবে সর্বনিম্ন দাম ধরলেও একটি বড় চামড়ার দাম দাঁড়ায় ১ হাজার ৮০০ টাকা, মাঝারি ১ হাজার ২০০ টাকা এবং ১৫ ফুটের ছোট চামড়ার দাম হয় ৯০০ টাকা। কিন্তু মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় চামড়া বিক্রি করতে পারছেন। এর চেয়ে বেশি দামে কোনোভাবেই চামড়া বিক্রি করা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী বলেন, কুরবানির দিন বিকালে প্রতি পিস চামড়া সর্বনিম্ন ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় ক্রয় করেছি। বিক্রি করেছি সর্বনিম্ন ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছি।
জানা গেছে, সিলেট শহরে কোরবানি দেওয়া পশুর চামড়া কেনাবেচার অস্থায়ী হাট বসে রেজিস্ট্রারি মাঠে। ঈদের দিন বিকেলে এই হাটে অনেককে চামড়া নিয়ে আসতে দেখা যায়। কাউকে কাউকে চামড়ার দাম শুনে রাগ করে বিক্রি না করে মাঠে ফেলে যেতে দেখা গেছে।
নগরীর সুবিদবাজার এলাকার আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করে বলেন, গরুর চামড়া বিক্রি করতে রেজিস্ট্রারি মাঠে নিয়ে যাই। মাত্র ১৫০ টাকায় চামড়া বিক্রি করেছি। অথচ যাওয়া-আসায় এর চেয়ে বেশি রিকশাভাড়া দিতে হয়েছে।
সিলেটের ব্যবসায়ীদের দাবি, গত ১৫ বছর ধরে সিন্ডিকেটে জিম্মি চামড়া ব্যবসা। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে সিলেটের ব্যবসায়ীদের বড় অঙ্কের টাকা বকেয়া রয়েছে। অন্যদিকে আবহাওয়াও অনুকূলে নেই। এ অবস্থায় নতুন করে চামড়া ব্যবসায় বিনিয়োগ মানে ঝুঁকি বাড়ানো।
তারা জানান, সারাবছর সিলেটে প্রতি পিস গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কেনা হয়। প্রক্রিয়াজাত করে সেগুলো ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয় তাদের। কেনা দামেও অনেক সময় তারা নিতে চান না। বাধ্য হয়ে কমদামে এবং বাকীতে বিক্রি করতে হয়। এক বছরের টাকা পরের বছর দেওয়ার শর্তেও অনেক সময় চামড়া ছাড়তে হয়।
এ ব্যাপারে সিলেটের শাহজালাল চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মিয়া দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সরকারের দাম নির্ধারণ রীতিমত একটা ভাওতাবাজি। শুধু দাম নির্ধারণ করলেই হয়না। বাস্তবতার আলোকে মাঠের চিত্র দেখে পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হয়। ১৫০ টাকায় কেনা চামড়াতেও ব্যবসায়ীদের ২৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত খরচ রয়েছে। এবছর সরকারীভাবে শুধুমাত্র মাদ্রাসায় লবণ সরবরাহ করা হয়েছে। অথচ মাদ্রাসাগুলোতে চামড়া লবনজাতের কোন অভিজ্ঞতা নেই। এই লবণগুলো ব্যবসায়ীদের মাঝে বিতরণ করলে তারা উপকৃত হতো। আর বেশী দামে চামড়া ক্রয় করা সম্ভব হতো।
তিনি বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি সরকারীভাবে সিলেটের বিভিন্ন মাদ্রাসায় ২০ লাখ টাকার বেশী লবন প্রদান করা হয়েছে। অথচ মাদ্রাসাগুলো ঈদের দিনেই কুরবানীর চামড়াগুলো ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছে। মাদ্রাসার চামড়াগুলো সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকা পর্যন্ত দামে কেনা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- ঈদের দিনেই মাদ্রাসাগুলো চামড়া বিক্রি করে দিলো, তাহলে সরকারীভাবে বরাদ্দ তাদের লবন গেল কই? শুনেছি বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে এসব লবন দোকানে বিক্রি করা হয়েছে। এভাবে পরিকল্পিতভাবে দেশের চামড়া শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এভাবে দেশে চামড়ার সুদিন ফিরবেনা। উল্টো ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারাবে।