ইরানের প্রতিশোধের আগুন, হামলায় দিশেহারা ইসরায়েল
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুন ২০২৫, ৫:৫৩:০৩ অপরাহ্ন
নিহত ৮ জনসহ অসংখ্য ইসরায়েলী আহত
তেল শোধানাগার, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অসংখ্য স্থাপনা বিধ্বস্ত
জালালাবাদ রিপোর্ট : প্রতিশোধের আগুনে যেন জ্বলছে ইরান। ঈমানের চেতনায় উজ্জিবিত ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ইসরায়েলজুড়ে ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে। এতে অনেকটা দিশেহারা অবস্থা ইহুদিবাদি ইসরায়েলের। দিশেহারা অবস্থায় ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইসরায়েল। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এক্সিওসের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে।
রোববার আল জাজিরার লাইভ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাইফা, তেল আবিবসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় রোববার অন্তত: ৮ জন নিহত হয়েছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে ইসরায়েলের হাইফা, তেল আবিবসহ বিভিন্ন এলাকা।
ইসরায়েলের দুই এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান : ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শনিবার দিবাগত রাতে ৮ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে বিবিসি। ইসরায়েলের জরুরি সেবা কর্তৃপক্ষ মাগেন ডেভিড অ্যাডম (এমডিএ) বলেছে, তেল আবিবের বাত ইয়াম এলাকায় তিনজন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৯ বছর ও ৮০ বছর বয়সী দুই নারী এবং ১০ বছর বয়সী এক শিশু আছে। আহত হয়েছেন আরও ১০০ জন।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, উত্তরাঞ্চলীয় শহর তামরাতে হামলায় কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। বাত ইয়াম শহরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তিনজন নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের তেল শোধনাগার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত :
ইরানের হামলায় ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর হাইফার একটি তেল শোধনাগার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তেল শোধনাগারটি পরিচালনাকারী ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান ‘বাজান’ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বরাতে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম এই তথ্য দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ইরানের রাতভর হামলায় তেল শোধনাগার কমপ্লেক্সের ভেতরে পাইপলাইন ও সঞ্চালন লাইনের কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় ক্ষতি হয়েছে। তেল শোধনাগারটি এখনো চালু আছে। তবে কিছু ইউনিট ও স্থাপনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতির প্রভাব মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
এই খবর এমন একসময় এল, যখন ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইরানি বাহিনী রাতভর ইসরায়েলের দিকে প্রায় ৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এগুলোর মধ্যে ৪০টি পড়েছে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে। এই অঞ্চলেই হাইফা অবস্থিত। খবর আল জাজিরার।
ইসরায়েলের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরানের হামলা, ভবনে ক্ষয়ক্ষতি : ইরানের হামলায় ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় শহর রেহোভতে অবস্থিত গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় উইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি স্থাপনা নষ্ট হয়েছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট-এর খবরে বলা হয়েছে, এই হামলায় কেউ হতাহত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, ক্যাম্পাসের কয়েকটি ভবনে হামলা হয়েছে।
মোসাদের দুই গুপ্তচরকে গ্রেপ্তার ইরানের : ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে ইরান। আল জাজিরার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
আধা সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই দুই ব্যক্তি আলবোর্জ প্রদেশে বিস্ফোরক ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বানানোর সময় ধরা পড়েছেন।
ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত ইরান এর আগেও বহুবার মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অনেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে ও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। বিশেষ করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ব্যাহত করতে নাশকতা বা হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট বলল, বেদনাদায়ক ও কঠিন এক সকাল : ইরান পরশু রাতভর ইসরায়েলের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। রাতভর হামলার পরের সকালকে ‘অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও কঠিন’ বলে মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
হারজোগ বলেন, ইরানের এই হামলায় ইহুদি ও আরব, ইসরায়েলি নাগরিক ও নতুন অভিবাসী-শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে-নিহত ও আহত হয়েছেন।
ইয়েমেন থেকে হুতিরাও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে : ইসরায়েলে রোববার (শনিবার দিবাগত রাত) একের পর এক হামলা হয়েছে। বোমা হামলা থেকে বাঁচতে ইসরায়েলি নাগরিকদের বারবারই নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর দিকে ছুটতে হয়েছে। ইসরায়েল বলছে, এবার এসব ক্ষেপণাস্ত্র শুধু ইরান থেকেই যে আসছে তা নয়, ইয়েমেন থেকে হুতিরাও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছেন হুতিরা। এর আগে তাঁরা গত মঙ্গলবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিলেন। এর জবাবে হুতিদের নিয়ন্ত্রণাধীন হোদেইদা বন্দরে বোমা হামলা চালায় ইসরায়েল।
ইরানের নিশানায় ইসরায়েলের হাইফা শহর : ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় শহর হাইফা। শহরটি নিশানা করে শনিবার ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার খবর ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে। খবরে হাইফায় বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাওয়ার তথ্যও জানানো হয়।
খবরে আরও বলা হয়, হাইফার উত্তরের কিছু শহরেও গতকাল ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। বদলা হিসেবে হাইফাসহ ইসরায়েল বিভিন্ন এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোন হামলা চালানোর কথা জানিয়েছে ইরান।
হাইফায় ইরানের হামলা নিয়ে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দাবি করা হয়, গতকাল ১০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে ছোড়া হয়, যার লক্ষ্য ছিল হাইফা ও তেল আবিব।
চ্যানেল ১২, টাইমস অব ইসরায়েলসহ ইসরায়েলি গণমাধ্যমে হাইফায় বিস্ফোরণ, বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের খবর দিয়ে বলা হয়েছে, এগুলো ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রভাব।
হাইফা ইসরায়েলের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। কিন্তু ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের উপকূলীয় এ শহরটি কেন গুরুত্বপূর্ণ, কেনইবা ইরানের লক্ষ্যবস্তু হাইফা?
ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, হাইফায় ইসরায়েলের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাঁটি আছে। এ ছাড়া এখানে বেশ কিছু তেল শোধনাগার ও বহু রাসায়নিক কারখানা আছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় তেল শোধনাগার হাইফা এলাকায় অবস্থিত।
হাইফা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একটি বন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, হাইফা ইসরায়েলের প্রধান গভীর সমুদ্রবন্দর। ইসরায়েলের সামুদ্রিক বাণিজ্যের একটি বড় অংশ এখান থেকে পরিচালিত হয়। ইসরায়েলের মোট পণ্য পরিবহনের প্রায় অর্ধেকই এই বন্দর দিয়ে পরিবাহিত হয়।
খামেনির উপর হামলার ইঙ্গিত ইসরায়েলের : ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ওপর হামলার ইঙ্গিত দিয়েছে ইসরায়েল। খবর আল-জাজিরার।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিও লক্ষ্যবস্তু হবেন-এটা মোটেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ তবে ওই কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি। ওই কর্মকর্তা আরও স্পষ্ট করে বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইসরায়েলি হামলার ‘সীমার বাইরে নন’।
ইরানের ওপর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার ‘কড়া জবাব’ দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।
জরুরী বৈঠকের ডাক আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার : ইসরায়েলের হামলার জেরে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজমা ক্রমে বাড়তে থাকার মধ্যেই জরুরী বৈঠকের ডাক দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)।
আজ সোমবার সকালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অবস্থিত সংস্থাটির সদর দপ্তরে ওই বৈঠক শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএ’র খবরে বলা হয়েছে যে, দেশটির পারমানবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলার পর দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত থাকায় জরুরি বৈঠক ডাকার জন্য আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানায় রাশিয়া এবং ভেনেজুয়েলা। সেই প্রেক্ষিতেই আজ সোমবার জরুরী বৈঠক আহ্বান করেছে সংস্থাটি।