নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বাদ পড়ছে আ.লীগ আমলের সংস্থাগুলো
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুন ২০২৫, ৯:২৫:১৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। এর অংশ হিসেবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালাও চূড়ান্ত করেছে সংস্থাটি। বিগত নির্বাচনে নামধারী যেসব সংস্থা পর্যবেক্ষণ করেছিল তাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তবে পরবর্তী সময়ে যাচাই-বাছাইয়ে যারা অনুমোদন পাওয়ার যোগ্য তাদের অনুমোদন দেওয়া হবে।
ইসি সূত্র জানায়, ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা ২০২৫’ চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এখন প্রজ্ঞাপনের অপেক্ষা। এই নীতিমালায় স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। কোনো ভুয়া ও নামধারী সংস্থা যেন পর্যবেক্ষণের সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতা ধরে রেখে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের আয়োজন করে। এসব নির্বাচনে নিজের পছন্দের কথিত বেশ কিছু সংস্থাকে পর্যবেক্ষণের অনুমতিও দেয়। এসব সংস্থার পক্ষপাতদুষ্ট পর্যবেক্ষণ নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনাও হয়। এজন্য আওয়ামী লীগ আমলে দেওয়া সব সংস্থার অনুমোদন বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করছে। এর মধ্য থেকে কেউ কেউ পুনরায় অনুমতি পেতে পারে। তবে তাদের সব শর্ত পূরণ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ বলেন, আমরা পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধনের সমস্ত ক্রাইটেরিয়া পুনর্মূল্যায়ন করব। এরপর আমরা যদি মনে করি এগুলো রাখার দরকার আছে, তাহলে রাখব। আর যদি মনে করি একটু পরিমার্জন বা পরিবর্তন করা দরকার, আমরা সেটা করব। তারপরে যারা যারা আমাদের ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে পড়বে তাদের আমরা পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে রাখব। ভুল তথ্য ও অপপ্রচার থেকে কমিশন সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকবে।
নতুন নীতিমালায় যা আছে: নতুন নীতিমালার গুরুত্ব ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটের অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। অতীতে বেশ কিছু নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের অভাব বা অনিয়ম দেখা গেছে, যা ভোটারের আস্থা কমিয়েছে। তাই, নির্বাচন কমিশন একটি সুসংগঠিত, স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের প্রতিটি ধাপকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
পর্যবেক্ষক নির্বাচন ও যোগ্যতার শর্তাবলিতে বলা হয়েছে, ভোটার ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সুরক্ষায় যে কেউ পর্যবেক্ষক হতে পারবে না। পর্যবেক্ষক হওয়ার জন্য বাংলাদেশি নাগরিকত্ব আবশ্যক, বয়স কমপক্ষে ২৫ বছর হতে হবে এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে ন্যূনতম এইচএসসি বা সমমানের সনদ থাকতে হবে। এছাড়াও, যারা নির্বাচন-প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, রাজনৈতিক দল বা দলের অঙ্গসংগঠনের সাথে ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা রাখেন, তাদেরকে পর্যবেক্ষক হতে দেওয়া যাবে না। এর ফলে নির্বাচনে পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা হ্রাস পাবে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক হতে হলে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার বা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনকৃত পর্যবেক্ষকদের জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে মুদ্রিত ‘পর্যবেক্ষক পরিচয়পত্র’ প্রদান করা হবে, যা সবার কাছে দৃশ্যমান রাখতে হবে এবং অন্য কারো কাছে হস্তান্তরযোগ্য নয়। স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের পরিচয়পত্র সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের দফতর থেকে নিতে হবে।
এছাড়া, প্রতিটি নির্বাচনি এলাকা অনুযায়ী পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে তাদের পর্যবেক্ষকদের তালিকা নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে জমা দিতে হবে এবং সেই তালিকা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদেরও দেখাতে হবে, যাতে তাদের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষকের নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ উঠলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
পর্যবেক্ষক মোতায়েনের একক ইউনিট হবে উপজেলা, মেট্রোপলিটন থানা অথবা সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা। একই এলাকার জন্য একাধিক সংস্থা আবেদন করলে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে কে কোথায় মোতায়েন হবে। প্রতি সংস্থা সর্বোচ্চ পাঁচজন করে ভ্রাম্যমাণ পর্যবেক্ষক দল রাখতে পারবে, যারা ভোটকেন্দ্রে স্বল্প সময়ের জন্য অবস্থান করে ভোটগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করবে। ভোট গণনার সময় প্রতিটি ইউনিটে একজন করে পর্যবেক্ষক উপস্থিত থাকবেন, যারা ভোট গণনা ও ফলাফল একত্রিতকরণের পুরো প্রক্রিয়া নজরে রাখবেন। ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা গণনাকক্ষ ত্যাগ করতে পারবেন না।
পর্যবেক্ষকদের করণীয় ও আচরণবিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, নির্বাচন চলাকালে পর্যবেক্ষকদের অবশ্যই ভোটারের গোপন ভোট প্রদানের অধিকার রক্ষা করতে হবে এবং নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাজ নির্বিঘ্ন করতে হবে। তাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করা নিষিদ্ধ। পর্যবেক্ষকগণ ভোটের গোপন কক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। তাদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব, রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে আচরণ, নির্বাচন উপকরণ স্পর্শ বা অপসারণ, কোন উপহার গ্রহণ বা সুবিধা নেওয়া নিষিদ্ধ। মিডিয়ার সামনে নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত করার সম্ভাবনা থাকা মন্তব্য থেকে বিরত থাকতে হবে।
পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে পর্যবেক্ষকদের প্রশিক্ষণ, নৈতিকতা রক্ষা ও কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার। কোনো পর্যবেক্ষক স্বার্থের সংঘাত বা অন্য অসঙ্গত আচরণ করলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে অবহিত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কূটনৈতিক মিশনগুলোর নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। তবে বিদেশি কর্মকর্তা ও স্থানীয় কর্মচারীরা যথাক্রমে বিদেশি ও স্থানীয় পর্যবেক্ষক হিসাবে আবেদন ও নিবন্ধন করতে হবে। বিদেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালা ও স্থানীয় পর্যবেক্ষক নীতিমালা আলাদা হলেও উভয়েরই নিয়মনীতির অধীন কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
প্রতিবেদন সংক্রান্ত বিধানে বলা হয়েছে, ভোটগ্রহণের ৭ দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হবে। এরপর ভোটগ্রহণ শেষে এক মাসের মধ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ও পর্যবেক্ষণের সামগ্রিক প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও উন্নত করার সুপারিশ থাকে।
২০০৮ সাল থেকে ভোট পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যবেক্ষক নিবন্ধন দিচ্ছে ইসি। সে সময় ১৩৮টি সংস্থা নিবন্ধন পেয়েছিল। ২০১৮ সালে ১১৮টি সংস্থাকে নিবন্ধন দেয় ইসি। ২০২৩ সালে ৯৬টি পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। প্রতি সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য দেশীয় সংস্থাগুলোকে নিবন্ধন নেওয়ার জন্য আহ্বান জানায় সংস্থাটি। এক্ষেত্রে নিবন্ধন পেয়ে সংস্থাগুলো পরবর্তী পাঁচ বছর স্থানীয় নির্বাচনও পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, গত সংসদ নির্বাচনে দেশীয় বিভিন্ন সংস্থার ২০ হাজার ৭৭৩ জন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আবেদন করেছিলেন। ইসি কেন্দ্রীয়ভাবে ৪০টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ৫১৭ জন এবং স্থানীয়ভাবে ৮৪টি পর্যবেক্ষণ সংস্থার ২০ হাজার ২৫৬ জনকে ভোট পর্যবেক্ষণের অনুমোদন দিয়েছিল। সে সময় পর্যবেক্ষক হতে হলে ন্যূনতম মাধ্যমিক পাস এবং ২৫ বছরের বেশি বয়সী হতে হয়। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসি ৩৪ দেশ ও চারটি সংস্থার শতাধিক পর্যবেক্ষককে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর বিদেশি সাংবাদিক ও বিভিন্ন সংস্থার ১৬৮ জন ভোট দেখতে আসতে পেরেছিলেন। এদের মধ্যে ইসির আমন্ত্রিত ছিলেন মাত্র ১৯ জন। এর আগে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওআইসি ও কমনওয়েলথ থেকে ৩৮ জন, বিভিন্ন মিশনের ৬৪ জন এবং বাংলাদেশস্থ বিভিন্ন দূতাবাসে বা হাইকমিশনে কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন; মোট ১৬৩ জন পর্যবেক্ষক ভোট পর্যবেক্ষণ করেন।