প্রাণ ফিরলো সংলাপে, অংশ নিলো জামায়াত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুন ২০২৫, ১২:৩৫:২০ অপরাহ্ন
# ডা: শফিককে প্রধান উপদেষ্টার ফোন
# এনসিসির পক্ষে জামায়াত-এনসিপি, বিপক্ষে বিএনপি
স্টাফ রিপোর্টার : ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপের প্রথম দিন বয়কট করেছিলো ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের বড় দল জামায়াতে ইসলামী। তাতে হোঁচট খেয়েছিলো প্রথম দিনের সংলাপ। বয়কটের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনুস ফোনে কথা বললেন জামায়াত আমীর ডা: শফিকুর রহমানের সঙ্গে। আশ্বস্ত করলেন, সরকার নিরপেক্ষ। প্রধান উপদেষ্টার এ আশ্ব^াসের প্রেক্ষিতে বুধবার দ্বিতীয় দিনে অংশ নিলো জামায়াত। এতে যেন প্রাণ ফিলে পেলো জুলাই সনদ নিয়ে আয়োজিত সংলাপ।
সংলাপে জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আলোচনায় অংশ নেন। সাথে ছিলেন সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও ড. হামিদুর রহমান আযাদ। বুধবার বেলা ১১টার পর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই বৈঠক শুরু হয়।
বৈঠক শেষে ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে প্রথম দিনের বৈঠকে আমরা আসিনি। পরে প্রধান উপদেষ্টা জামায়াত আমীরের সাথে যোগাযোগ করে নিরপেক্ষতার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন।
তিনি বলেন, লন্ডনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠককে স্বাগত জানিয়েছে জামায়াত। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নিয়েও আপত্তি ছিল না। আলোচনার মাধ্যমে তা পরিবর্তন হতে পারতো। কিন্তু উনি (প্রধান উপদেষ্টা) একটি দলের সাথে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। এতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও বিব্রত হয়েছে। বিএনপিকে নিয়ে নয়, যৌথ বিবৃতি ও বিফ্রিং নিয়েই জামায়াতের আপত্তি।
এদিকে, গতকালের সংলাপে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার জানিয়েছেন, বুধবার জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা হয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে।
এছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, নিম্নকক্ষে নারী আসন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সুপারিশ নিয়ে আগের আলোচনার বিষয়টিও সূচিতে রাখা হয়।
এনসিসির পক্ষে জামায়াত-এনসিপি, বিপক্ষে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল :
রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিষয়টি নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে মত দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
বিএনপি বরাবরের মতো আজও এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করেছে। আজকের আলোচনায় বিএনপির সমমনা ১২–দলীয় জোটও এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ (এবি পার্টি) কয়েকটি দল এনসিসি গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে তারা এনসিসির গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু ভিন্নমতের কথা বলেছে।
যা বললো জামায়াত :
সংলাপে নিজেদের মতামত তুলে ধরে জামায়াত। প্রথমত সাংবিধানিক কাউন্সিলের পক্ষে জামায়াত। এর মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। তবে এর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির সম্পৃক্ততা চায় না দলটি। কারণ তারা দুই জনই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকেন। তাছাড়াও কোনও বিষয়ে বিরোধ হলে সমাধান করবেন কে? তাই সেখানে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা ও স্পিকার থাকবেন। তবে এনসিসির গঠন ও আওতা নিয়ে ভিন্নমতের কথা জানায় দলটি। তিন বাহিনী প্রধানের নিয়োগও এই কমিটির আওতায় না রাখার পক্ষে জামায়াতে ইসলামী। তবে বিষয়টি আরও আলোচনার দাবি রাখে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চায় জামায়াতে ইসলামী। ডা: তাহের বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইউনিয়ন মেম্বার পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার ইলেক্টরাল বডি তৈরি হবে। তাদের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে বলে কমিশন প্রস্তাব করেছে। অতীতে দেখেছি যেই সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হয় তারাই সেই নির্বাচনে জয়ী হয়। এমনটা হলে ৭০ হাজার ইলেক্টরাল কোনও কাজে দেবে না। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হতে হবে। এতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মেম্বার নির্বাচিত হবে।
নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে অনিশ্চয়তা নেই- স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর এ বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে জামায়াত।
এছাড়া মেয়র পদের জন্য নগর ভবন তালাবদ্ধ করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, যিনি একমাসেও একটি ভবনের তালা খুলতে পারেন না, ৩০০ সংসদীয় আসনের কিভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবেন, সেটাও বিস্ময়ের ব্যাপার। আমি উনাকে সংযতভাবে কথা বলার অনুরোধ করছি। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কী হবে, এটা বুঝার জন্য অনুরোধ করছি।
যা বললো বিএনপি :
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রস্তাবিত ইলেকট্রোরাল কলেজব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বলে সংলাপে মন্তব্য করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জনগণের ভোটাধিকার হরণে এই ব্যবস্থাকে আরেকটি ছলচাতুরী হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবে আগের মতোই একমত নয় বিএনপি। এই কাউন্সিলের জবাবদিহি না থাকায় সমর্থন করে না বিএনপি। এই কাউন্সিলে আরেকটি ভারসাম্যহীন অবস্থা তৈরি হবে বলে মনে করি আমরা।
স্বাধীন বিচারব্যবস্থার দাবি জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘স্বাধীন বিচারব্যবস্থা হলে ভারসাম্যহীনতা দূর হবে, ফ্যাসিবাদ দমন করবে। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য, অন্য সাংবিধানিক পদ, সংস্থা স্বাধীন করতে পারলে সমস্যা থাকবে না।
বিএনপি মনে করে সুশাসন নিশ্চিত করতে ন্যায়পাল করা যেতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থা বজায় রেখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হলে তাদের যোগ করা যেতে পারে, বলেন তিনি। নির্বাচন কমিশন আইন সংশোধন করা যেতে পারে। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বিএনপি মনে করে, দুদক ও মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করতে বিদ্যমান আইনগুলো সংস্কারের প্রয়োজন।
সংলাপ থেকে গণফোরাম ও সিপিবির ওয়াকআউট :
বৈষম্যের অভিযোগ তুলে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ থেকে ‘ওয়াকআউট’ করেছেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. মিজানুর রহমান, সিপিবির রুহিন হোসেন প্রিন্স, ১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক শাহাদাত হোসেন সেলিম। পরে ঐকমত্য কমিশনের আশ্বাসে বৈঠকে ফিরে যান তাঁরা। সংলাপে জামায়াত নেতাদের বেশি কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করেন তাঁরা।
বুধবার বিকেল পৌনে ৪টার দিকে জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা: সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের বক্তব্য শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দীন আহমদ বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। এমন সময় প্রথমে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সংলাপস্থল থেকে বের হয়ে যান। তাঁর পেছনে বের হন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সসহ দুজন।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, আইয়ুব মিয়া, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।