ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ : আলোচনায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুন ২০২৫, ১১:৪৩:২৮ অপরাহ্ন
ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের পক্ষে জামায়াত, বিপক্ষে বিএনপি
জালালাবাদ রিপোর্ট : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ বেশ জমে উঠেছে। সংলাপে হচ্ছে প্রাণবন্ত বিতর্ক, যুক্তি-পাল্টা যুক্তি, ওয়াক আউট। আসনে বসা ও বক্তৃতার সুযোগ কম দেয়া নিয়ে হয়েছে হট্টগোলও।
গতকাল তৃতীয় দিনের সংলাপে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, সংবিধান, রাষ্ট্রের মূলনীতি ও নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
আলোচনায় ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ব্যবস্থায় মত দিয়েছে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল জানিয়েছে, আপাতত তিন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে যার সবকটিই ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত।
এ ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নায়েবে আমীর ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে এবং নারী আসন ১০০ হলে উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষ মিলিয়ে ৫০০ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
এদিকে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করতে সংবিধান সংশোধনে প্রায় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শেষে সমাপনী ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধানের ৪৮ (১) অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন চান সবাই। তবে নতুন প্রক্রিয়ার প্রায় পুরোটাই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই আগে আইনসভা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৫০০ ভোটের ইলেকটোরাল কলেজ হবে, নাকি জেলা পরিষদ-সিটি করপোরেশন যোগ হবে- এর অনেক কিছুই নির্ভর করছে আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হবে কিনা তার ওপর। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত মীমাংসায় আসতে চাইলে আগে আইনসভার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ প্রসঙ্গেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি উল্লেখ করে কমিশনের সহসভাপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী পরপর দুই মেয়াদে হলে আর হওয়া যাবে না কিংবা পরে এক বা দুই মেয়াদ বাদ দিয়ে হওয়া যাবে- এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কোনও সিদ্ধান্ত পৌঁছান যায়নি।
এ সময় কমিশনের সদস্য হিসেবে ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গতকালের আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়।
যে মত দিলো জামায়াত :
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তারা বর্তমান সংসদ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটের পরিবর্তে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত প্রায় ৭০ হাজার সদস্যের ‘এক্সটেন্ডেড ইলেক্টোরাল কলেজ’-এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে দলটি জোর দিয়েছে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সরকারের অধীনে নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে হবে।
তৃতীয় দিনের প্রথম পর্বের বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের এসব কথা জানান।
ডা: তাহের বলেন, গতকাল সকালে মূলত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কিভাবে হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা নীতিগতভাবে একটি এক্সটেন্ডেড ইলেক্টোরাল কলেজ-এর পক্ষে, যেখানে পার্লামেন্টের সদস্য (যদি আপার হাউজ হয় তবে উভয় কক্ষের) এবং জেলা পরিষদ, মিউনিসিপ্যালিটি, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বার পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার জনপ্রতিনিধি থাকবেন।
তিনি বলেন, আমরা বলেছি যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনও সরকারের অধীনে হতে হবে, যেমনটি পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়। কারণ, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, তাহলে যারা নির্বাচিত হবেন তারা তো প্রকৃত জনপ্রতিনিধি হবেন না।
এ বর্ধিত নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য সংখ্যার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী নমনীয়তা প্রকাশ করেছে। ডা: তাহের জানান, বিভিন্ন পক্ষ জেলা পরিষদ, উপইউনিয়ন পর্যন্ত অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন। সকলে মিলে যে পর্যন্ত ঐকমত্য হতে পারি, সেখানে জামায়াত ইসলামী তার মতকে সংশোধন করতে পারে।
বৈঠকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রায় সবাই একমত হয়েছেন বলে জানান ডা: তাহের-তা হলো গোপন ব্যালটে নির্বাচন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তার শুরু থেকেই সকল অভ্যন্তরীণ নির্বাচন গোপন ব্যালটে করে থাকে। তাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ নিয়ম কার্যকর হলে তা ভোটের জন্য ভালো।
এছাড়া জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়েও প্রস্তাব দিয়েছে, যা এখনো আলোচনার এজেন্ডায় আসেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
যা বলল বিএনপি :
৭০ হাজার স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিকে ভোটার করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে প্রস্তাব কমিশন দিয়েছে, বিএনপি তা সমর্থন করে না। বিএনপির প্রস্তাব- বর্তমান সংসদীয় কাঠামোয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন জাতীয় সংসদ সদস্যদের ভোটে হওয়া উচিত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে কোনো সমাধানে আসা যায়নি। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে বর্তমানে আমরা সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকেই যৌক্তিক মনে করি।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে আলোচনা চলছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতে চায়। সরাসরি যারা নির্বাচিত হবেন তারা এবং উচ্চ কক্ষের ১০০ ও নারী আসনে ১০০ জন মিলে এ সিদ্ধান্ত নেবে।
তিনি বলেন, যেহেতু আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ ওপেন করেছি, তাই আমরা মনে করি সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। সেখানে গোপন ভোট হতে পারে। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সিদ্ধান্ত এখনও পেনডিং রাখা আছে। দুই তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে। তবে পিআর পদ্ধতিতে আপার হাউজ ভোট রাখা হলে অর্ধেক মেজরিটি পাবে না, তাই এটি আমরা সমর্থন করি না।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ বিষয়ে তিনি বলেন, পর পর মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হবেন না। আর স্বৈরাচার ফরমেশন ঠেকাতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হবে। তখন এনসিসি গঠন করা লাগে না বলে মনে করেন বিএনপির এ সিনিয়র নেতা।