নির্বাচন আয়োজনে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুন ২০২৫, ৩:৫৯:১১ অপরাহ্ন
আটকে আছে ইসির গুরুত্বপূর্ণ কাজ
ঐকমত্যের সংলাপে এখনো মতানৈক্য
জালালাবাদ রিপোর্ট : দেশে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, নির্বাচন এপ্রিলের যেকোন সময়। এরপর লন্ডনে তারেক রহমানের বৈঠকের পর বলা হলো ফেব্রুয়ারিতেও হতে পারে। এ নিয়ে দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে কৌতুহল। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভোট নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এদিকে, ফেব্রুয়ারী না এপ্রিল এ নিয়ে যখন চলছে আলোচনা, তখন জানা গেলো নির্বাচনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে কোন সবুজ সংকেত দেয়নি সরকার। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন রোববার ঈদের পর প্রথম কর্মদিবসবে সাংবাদিকদের নিজেই এ তথ্য জানিয়েছেন। ফলে নির্বাচন কমিশনও সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ফেব্রুয়ারী কিংবা এপ্রিল-এই সময়ে নির্বাচনে কতটা প্রস্তুত ইসি।
এছাড়া জামায়াত, এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিও রয়েছে। বিএনপিসহ অন্য বেশকিছু দল জাতীয় নির্বাচনই আগে অনুষ্ঠানের পক্ষে। এ ইস্যুর সমাধান এখনও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা পর্যায়েই রয়েছে, সমাধান হয়নি।
ওদিকে, শেষ পর্যন্ত সবাই নির্বাচনের সময়সীমা মেনে নিলেও নির্বাচনটিকে অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, উৎসবমুখর ও গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে কী কী চ্যালেঞ্জ সরকারকে আগামী দশ মাসে মোকাবেলা করতে হবে- সেই আলোচনাও উঠছে।
বিশেষ করে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াও এই অল্প সময়ের মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণের মতো জটিলকাজ, আইনশৃঙ্খলা সহ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো শেষ করার সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে কি-না সেই প্রশ্নও আছে।
প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেছেন, ইতিহাসের সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য সকল পক্ষের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি।
যদিও তার ঘোষিত নির্বাচনের সময়সীমাই বিতর্কের মুখে পড়েছে। জামায়াত শুরু থেকেই বলছে, নির্বাচনের আগে সংস্কার, জুলাই সনদ ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একই বক্তব্য অভ্যূত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের সংগঠন এনসিপিরও।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ অবশ্য বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে আগামী মাসের মধ্যেই ‘জুলাই সনদ’সহ সংস্কার কর্মসূচিগুলো চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।
যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে আসবে :
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোন বিষয়গুলোতে সংস্কার হবে সে বিষয়ে সব দলকে এক করা, আন্দোলনের সময় হওয়া হত্যাকাণ্ডের বিচারকে ‘গ্রহণযোগ্য’ করার পাশাপাশি পক্ষপাতহীন নির্বাচনের পরিবেশ ও একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সরকার যে তৈরি করতে পারবে- এই আস্থা তৈরি করাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
এছাড়া আইনশৃঙ্খলা ঠিক করা, পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযোগী করা, বিতর্কহীন ভোটার তালিকা তৈরি করা, নির্বাচনি আসনের সীমানা নির্ধারণ কি পুরনো আইনে হবে নাকি নতুন আইন করা হবে, আবার নতুন আইনে হলে তার ভিত্তিতে এই জটিল কাজ এতো অল্প সময়ে করা সম্ভব কি-না- সেই চ্যালেঞ্জগুলোও সরকারের সামনে থাকবে বলে তারা মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, সরকারের সামনে প্রকৃত চ্যালেঞ্জই হবে নিজে নিরপেক্ষ থেকে একটি পক্ষপাতহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন তারা যে করতে চায়, সেই আস্থাটা অর্জন করা। আইন শৃঙ্খলা ও নির্বাচন কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
ইতোমধ্যেই তারেক রহমানের সাথে বৈঠকের পর যৌথ ব্রিফিংয়ের জন্য সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জামায়াত। বিএনপির পক্ষ থেকেও সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে এবং দু’জন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবি করেছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা: শফিকুর রহমান আগামী নির্বাচনে ‘সম্ভাব্য ডাকাতির’ বিষয়ে হুশিয়ার করেছেন। ঈদের সময় মৌলভীবাজারে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, জাতি যেনতেন নির্বাচন চায় না।
বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী বলেছেন, সরকার এখনো আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করতে পারেনি। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত সরকার কতটা করতে পারবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, এনসিপি ও জামায়াত তো ভোট ডাকাতির আশঙ্কা প্রকাশ করছে। তাদের অভিযোগ প্রশাসন চালাচ্ছে বিএনপি। আবার বিএনপি বলছে সরকার নিজেই নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কিভাবে হবে সেটি সরকারকে ঠিক করতে হবে।
যদিও প্রধান উপদেষ্টার সাথে তারেক রহমানের বৈঠকের পর সরকারের সাথে বিএনপির টানাপোড়েন কিছুটা দূর হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ইশরাক হোসেনের জোর করে নগর ভবন দখলে নেয়ায় জনমনে ক্ষোভ রয়েছে এবং এ নিয়ে সরকার কঠো সিদ্ধান্তে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
একইসাথে দু’দিন আগে জামায়াত আমীরের সাথেও প্রধান উপদেষ্টা ফোনে কথা বলেছেন। সরকার নিরপেক্ষ বলেও নিশ্চয়তা দিয়েছেন তিনি।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে গত এগার মাসে সরকার সংস্কার ইস্যুতে কিছু করতে পেরেছে কি-না এবং একই সাথে সংস্কার বাস্তবায়ন এ সময়ে সম্ভব কি না।
আবার ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা করে তারপর সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে পরের আট মাসে নির্বাচন আয়োজনের মূল চ্যালেঞ্জ কতটা গুরুত্ব পাবে, সেই আশংকাও আছে অনেকের মধ্যে।
যদিও আলী রীয়াজ বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে সহযোগিতা করছে সেটি অব্যাহত থাকলে জুলাই সনদসহ সংস্কারের দিকগুলো বাস্তবায়নের জন্য চূড়ান্ত হয়ে যাবে । এরপরেও কিছু বিষয় থাকবে যেগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই সবাই একমত নাও হতে পারে। সে বিষয়গুলো আমরা জনগণকে অবহিত করবো।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী দশ মাসেই সরকারকে সংস্কার কার্যক্রমে বড় অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। আবার বিচারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল করা হলেও কথা উঠছে ‘গ্রহণযোগ্য বিচার’ কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে তা নিয়েও।
এদিকে, ঐকমত্য কমিশনের সংলাপেও এখন পর্যন্ত অনেক বিষয়ে সমাধান করা যায়নি। গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি ও সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচনপদ্ধতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ (এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন)-এই তিন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত বা ঐকমত্য হয়নি। মূল আলোচ্য বিষয় ছিল আগের অসমাপ্ত আলোচনা শেষ করা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও রাষ্ট্রের মূলনীতি। এর মধ্যে আগের অসমাপ্ত আলোচনা শুরু হলেও শেষ করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ প্রশ্নেও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। আর তৃতীয় আলোচ্যসূচি ‘রাষ্ট্রের মূলনীতি’ নিয়ে আলোচনাই শুরুই করা যায়নি।
আটকে আছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ :
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ বর্তমানে আটকে রয়েছে। ভোট আয়োজনের জন্য অপরিহার্য এমন নীতিনির্ধারণী বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রধান আইন আরপিও সংশোধন, নির্বাচনি আচরণ বিধিমালা ও নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন। আরও আছে, রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপ, ভোটার তালিকা আইন সংশোধন, নির্বাচন ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ এবং পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন কার্যক্রম।
তবে যেসব কাজের সঙ্গে সংস্কার ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই, সে কাজগুলোর প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে ইসি। এরই অংশ হিসাবে ভোটগ্রহণের কাজে ব্যবহৃত স্বচ্ছ ব্যালট বক্স, অফিশিয়াল সিল, মার্কিং সিল, গানি ব্যাগ, লাল গালাসহ ভোটগ্রহণের মালামাল সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। নির্বাচনি বিভিন্ন ফরম ও প্যাকেট ছাপার প্রস্তুতি নিতে বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
তাই স্বাভাবিকভাবেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এমনটি এপ্রিলেও কতটা সম্ভব- তা নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।