ঐকমত্যের সংলাপে মতবিরোধ : সামগ্রিক অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জুন ২০২৫, ৪:০৪:৫৪ অপরাহ্ন
দু’দিন বিরতি দিয়ে কাল ফের সংলাপ
জালালাবাদ রিপোর্ট : রাষ্ট্র সংস্কার ইস্যুতে একটি জাতীয় সনদ (চার্টার) তৈরির লক্ষ্যে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ম্যারাথন সংলাপ চলছে। সংলাপে আলোচনার প্রক্রিয়া, এজেন্ডা নির্ধারণ এবং সামগ্রিক অগ্রগতি কতটা-তা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় পর্যায়ের পঞ্চম দিনের সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ এবং সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়ায় প্রশ্ন আরো বেড়েছে।
ঐকমত্যের সূচনা বৈঠক হয় চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আনুষ্ঠানিকভাবে সেদিন সংলাপ উদ্বোধন করেন।
দেশ সংস্কারের লক্ষ্যে গত বছরের অক্টোবরে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়। ওইসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন খাতে মোট ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাব ওঠে আসে। এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিরতি দিয়ে দিয়ে প্রথম ধাপের আলোচনা চলে ১৯ মে পর্যন্ত।
আর দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু হয় ২ জুন। একদিন বৈঠক শেষে পবিত্র ঈদ-উল-আজহার পরে দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে ১৭ জুন থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত আলোচনা হয়। মাঝে শুক্রবার বাদ দিয়ে ২১ ও ২২ জুন আলোচনা চলে। এরপর ২৩ ও ২৪ জুন বিরতি দিয়ে কাল ২৫ জুন আবারো সংলাপ হবে।
কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আলোচনার প্রক্রিয়া, এজেন্ডা নির্ধারণ এবং সামগ্রিক অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। আবার মান-অভিমান সত্ত্বেও ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করছে জামায়াতসহ কিছু দল, যা রাজনৈতিক সমঝোতার পূর্বাভাস বলে ধারণা করছে তারা।
সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে বিতর্ক :
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে বক্তব্যে সালাউদ্দিন বলেন, বিএনপি পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরতে চায়-যেখানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং ‘আল্লাহর ওপর বিশ্বাস উল্লেখ’ ছিল। তারা পঞ্চদশ সংশোধনী মানে না।
তিনি বলেন, আমরা যদি জনগণের ম্যান্ডেট পাই, তাহলে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র সংবিধানে যুক্ত করব।’
জামায়াতের ডা: আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার বিষয়ে একমত হওয়ার কথা জানান। তবে তিনি বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাবে বামপন্থী দলগুলো বিরোধিতা করেছে।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বামপন্থী দলগুলো ১৯৭২ সালের মূলনীতির প্রশ্নে অনড়। তারা এগুলোকে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে মনে করে এবং এর কোনোটিই বাদ দেওয়ার বিরোধিতা করে। এই মূলনীতিগুলোর কোনোটিই বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, এই মূলনীতি পরিবর্তন করে ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
জোনায়েদ সাকি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনের সময়কার মূলনীতিগুলো থাকতে হবে। তবে এর সঙ্গে কিছু সংযোজন করা যেতে পারে।
তবে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে তারা ৭২ সালের মুজিববাদী মূলনীতির বিরোধিতা করেছেন। ওই মূলনীতি বাদ দিয়ে অন্য কোনো প্রস্তাব এলে তারা তা আলোচনায় নিতে প্রস্তুত।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসায় হতাশা :
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, অনেক ভালো আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাচ্ছে না। আমরা একবার আগাই, তিনবার পেছাই।
তিনি একটি ‘সঠিক প্রক্রিয়া’, ‘নির্দিষ্ট এজেন্ডা’ এবং ‘পরিষ্কার সিদ্ধান্তে’ পৌঁছাতে ‘নির্ধারিত সময়সীমার’ মধ্যে আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার ওপর জোর দেন। এ সময় তিনি জনগণের প্রত্যাশা এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের বিষয়টি তুলে ধরেন।
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, যদি এইভাবে চলতে থাকে, তাহলে কিয়ামত পর্যন্তও শতভাগ ঐকমত্য হবে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, এখানে ঐক্যমত্যের একটি মানদণ্ড বা মাপকাঠি নির্ধারণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে মতবিরোধ :
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে সংলাপে মতবিরোধ দেখা দেয়। শুরুতে সব দল একজন ব্যক্তি দুই মেয়াদে মোট ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রাথমিক প্রস্তাবে একমত হলেও, পরে তিনটি দল দ্বিমত প্রকাশ করে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে দলীয়ভাবে আলোচনা করতে হবে। কারণ এটি জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ (এনসিসি) ও উচ্চকক্ষের সঙ্গে জড়িত।
সালাউদ্দিন বলেন, আপনারা বলেছেন এটা বছরভিত্তিক হলে ভালো হয়, মেয়াদ ও বার ভিত্তিক হলে কনফিউশন (বিভ্রান্তি) থেকে যাবে। কিন্তু কত বছরে নির্ধারিত হবে সেটা আমার দলের পক্ষ থেকে জানাতে হলে প্রথমে এনসিসি ও উচ্চকক্ষ নিয়ে আলোচনা করে জানাতে হবে।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা: সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার জীবনকালে ১০ বছরের বেশি থাকতে পারবেন না।’
বিএনপি এ বিষয়ে ভিন্নমত দিয়ে সময় চেয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, জামায়াত চায় সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঠেকাতে।
এনসিপির তাসনিম জারা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুইবারে সীমাবদ্ধ রাখার প্রস্তাব দেন এবং জানান, মেয়াদ মোট ১০ বছর নির্ধারণ করলে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, মেয়াদ’ ও ‘বার’-এই শব্দ দুটি ঘিরে জটিলতা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, অধিকাংশ দল একজন ব্যক্তির জীবনকালে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন-এই প্রস্তাবে একমত হলেও তিনটি দল এতে দ্বিমত জানিয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বিএনপি, বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি) ও ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম) ভিন্নমত জানিয়েছে।
ঐকমত্য না হলে কী হবে?
দলগুলোর মধ্যে সংস্কার নিয়ে নানা বিভক্তির প্রশ্নে বিএনপিসহ কয়েকটি দল বলছে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়েই সংস্কার চূড়ান্ত করে জুলাই সনদ হতে হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যেগুলো ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়েই এগুতে হবে। সবাই তো সব বিষয়ে একমত হবে না।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, মৌলিক বিষয়ে সংস্কার হলে তখনই তার দল জুলাই সনদের দলিলকে সমর্থন করবে। মৌলিক বিষয়ে সংস্কার হলেই আমরা এই দলিলকে সমর্থন করবো বা এই প্রক্রিয়ায় যাবো।
সমাধান হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বলছে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো নিয়ে গণভোটের মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে। দলটির নেতা হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, যেসব ইস্যুতে ঐকমত্য হবে সেগুলো নিয়ে সনদ হতে পারে। কিন্তু যেগুলো নিয়ে মতপার্থক্য থাকবে, সেগুলো তো ফেলে রাখা যাবে না। তখন গণভোটে দিতে হবে। গণভোটে জনগণের রায়ের ভিত্তিতে একটা সেটেলমেন্ট আসবে। জনগণ যে প্রস্তাবে রায় দেবে, সেটা জুলাই সনদের জন্য গ্রহণ করা যাবে।
আরেকটু ছাড় দেওয়ার আহ্বান ড. আলী রীয়াজের :
সর্বশেষ ২২ জুন আলোচনার প্রারম্ভিক বক্তব্যে জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত বিষয়গুলোতে ঐকমত্য গঠনের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে কিছুটা ছাড় দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের উদ্দেশে আলী রীয়াজ বলেন, অনেকটা এগিয়ে এসেছেন, আরেকটু আগান। আরেকটু এগোলেই দ্রুত জুলাই সনদ করতে পারি আমরা। কোন জায়গায় আমরা একমত হতে পারি, কোন জায়গায় আমরা কতদূর এগিয়ে যেতে পারি, সেটা ভেবে আপনারা একটু ছাড় দেওয়ার জায়গায় আসুন।
ফের আগামীকাল ২৫ জুন (বুধবার) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা রয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের।