নারী নির্যাতন বেশি বরিশাল, কম সিলেটে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জুন ২০২৫, ৯:১৫:৪১ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : নারীদের সহিংসতার শিকার হওয়ার হার দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় তুলনামূলক বেশি। স্বামী বা সঙ্গীর হাতে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে বরিশাল ও খুলনায়। সবচেয়ে কম ঘটছে সিলেটে। তবে যেসব এলাকায় কম নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, সেখানেও নির্যাতনের মাত্রা উচ্চহারেই রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশের ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ প্রতিবেদন ২০২৪’-এ উঠে এসেছে এ তথ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সঙ্গী বা স্বামীর হাতে জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন-এমন নারীর হার বরিশালে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৮২ শতাংশ। উচ্চহার রয়েছে খুলনাতেও, ৮১ শতাংশ। সবচেয়ে কম সিলেটে, প্রায় ৭৩ শতাংশ। ঢাকাতেও এ হার ৭৩ শতাংশ। এছাড়া চট্টগ্রামে প্রায় ৭৬ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৭৫ শতাংশ, রাজশাহীতে প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং রংপুরে ৭৪ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
জরিপের সময় থেকে আগের ১২ মাসে এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন-এমন নারীর হারও বরিশালে বেশি, ৫৭ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে গত ১২ মাসে সবচেয়ে কম সহিংসতার শিকার হয়েছেন রাজশাহীর নারীরা, এ হার ৪১ শতাংশ। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ৫৩ শতাংশ, রংপুরে প্রায় ৫৩, খুলনায় প্রায় ৫২, সিলেটে ৫০, ময়মনসিংহে ৪৮ এবং ঢাকায় প্রায় ৪৫ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় প্রায় ৮১ শতাংশ (জীবদ্দশায় অন্তত একবার) নারীর সহিংসতার শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটলেও দুর্যোগপ্রবণ নয়-এমন এলাকায় এ হার ৭৪ শতাংশ। জরিপের আগের ১২ মাসে এ হার ছিল যথাক্রমে ৫৩ ও ৪৭ শতাংশ।
দুর্যোগ-বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের তীব্রতা বাড়ছে।
চট্টগ্রামে প্রায় ৭৬ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৭৫ শতাংশ, রাজশাহীতে প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং রংপুরে ৭৪ শতাংশ নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
মাঠের অভিজ্ঞতা থেকে দুর্যোগ-বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে পুরুষেরা কাজের সন্ধানে এলাকার বাইরে থাকেন। এ সময় নারীর ওপর সংসারের কাজ ও পরিবারের সদস্যদের দেখভালের দায়িত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। কাজ করার দিক দিয়ে তিনি পরিবারপ্রধান হয়ে উঠলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁর মতামত থাকে না। তাঁর বিরুদ্ধে শ্বশুর-শাশুড়ি থেকে শুরু করে সন্তান, এমনকি প্রতিবেশীরাও নানান অভিযোগ জমা করেন। পুরুষটি বাড়ি এসে এসব অভিযোগ শোনেন এবং নিজেও মনে করতে থাকেন, তাঁর স্ত্রী ‘কোনো কাজের নয়’। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শারীরিকের চেয়ে মানসিক নির্যাতনের ঘটনার ব্যাপকতা বেশি থাকে।
প্রতিবেদন অনুসারে, জাতিসংঘের পরিমাপের ভিত্তিতে বাংলাদেশে সঙ্গী বা স্বামীর হাতে জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও সহিংসতার শিকার হন ৭০ শতাংশ নারী। ৪১ শতাংশ নারীর ক্ষেত্রে গত ১২ মাসে এ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক—এমন সহিংসতামূলক আচরণ অন্তর্ভুক্ত করলে এ সহিংসতার ব্যাপকতা আরও বেশি-জীবনে অন্তত একবার ৭৬ শতাংশ নারী এবং গত ১২ মাসে ৪৯ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১২ মাসে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েরা (৬২ শতাংশ)। এই খানাভিত্তিক জরিপে শহর, গ্রাম, দুর্যোগপ্রবণ ও বস্তি এলাকার ১৫ বছর ও এর চেয়ে বেশি বয়সী ২৭ হাজার ৪৭৬ নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
বিভাগভিত্তিক আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হার :
প্রতিবেদন অনুসারে, বরিশালে সবচেয়ে বেশি হারে সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও সেখানে নারীদের সহিংসতার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হার মাত্র ৬ শতাংশ। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতেও একই হার, ৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম আইনি পদক্ষেপ ময়মনসিংহে, ৫ শতাংশ। অপর দিকে তুলনামূলক সবচেয়ে কম সহিংসতা ঘটা সিলেট ও ঢাকায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হার কিছুটা বেশি, যথাক্রমে ১৩ ও ৯ শতাংশ। এছাড়া রংপুর ও খুলনায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হার ৭ শতাংশ।
সহিংসতার অভিযোগ কোথায় জানানো যাবে, সে সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সচেতনতা রয়েছে খুলনার নারী (৬৬ শতাংশ) ও সিলেটের নারীদের (৬৫ শতাংশ)। সচেতনতার হার সবচেয়ে কম ঢাকায়, মাত্র ৩৪ শতাংশ। এছাড়া রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও রংপুরে এ সচেতনতার হার যথাক্রমে ৫৭, ৫১, ৫০, ৪৫ ও ৪৪ শতাংশ।
উচ্চশিক্ষা আছে ও শিক্ষা নেই-দুই পর্যায়েই সহিংসতা :
বিবিএস ও ইউএনএফপিএর প্রতিবেদন অনুসারে, জীবদ্দশায় অন্তত একবার সহিংসতার শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে নারীর শিক্ষা থাকা না–থাকা তারতম্য তৈরি করলেও গত ১২ মাসে সহিংসতার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখেনি। ডিগ্রি পাস বা তার চেয়েও বেশি বয়সী নারীর সহিংসতার শিকার হওয়ার হার জীবদ্দশায় ৬১ শতাংশ ও ১২ মাসে ৪২ শতাংশ এবং শিক্ষা নেই—এমন নারীর ক্ষেত্রে এ হার যথাক্রমে ৮০ শতাংশ ও ৪২ শতাংশ।
বিবিএসের ‘ইন্টিগ্রেটিং জিওস্পেশাল ইনফরমেশন উইথ জেন্ডার অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রজেক্ট’-এর প্রকল্প পরিচালক ইফতেখাইরুল করিম বলেন, ২০১১ ও ২০১৫ সালের পর এবার তৃতীয়বারের মতো জরিপটি করা হয়েছে। যাতে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার ধরন ও মাত্রা বোঝা যায়। এ জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে যেন সরকার সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কার্যকর পরিকল্পনা নিতে পারে, গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি হয় এবং পুলিশসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা বুঝতে পারেন তাঁদের করণীয় কী।
দুর্যোগ-বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারার মতে, নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে পারবে। কৃষি, গরু-ছাগল পালন ইত্যাদি থেকে নারীর প্রচলিত কিছু আয় ছিল। সেসব আয়ের উৎস কমে যাচ্ছে। নারীর আয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত দেওয়ার ব্যবস্থার মাধ্যমে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব।