সীমানা বিন্যাস ইস্যুতে চ্যালেঞ্জের মুখে ইসি
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০২৫, ১১:৩০:৪৮ অপরাহ্ন

২০০১ সালের সীমানায় ফেরাতে চাপ বাড়ছে
জালালাবাদ রিপোর্ট : ২০০১ সালের সংসদীয় আসনের সীমানায় ফিরে যেতে নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলের নেতাদের চাপ বাড়ছে। সীমানা পুনর্বিন্যাস চেয়ে ইতোমধ্যে ৭৬টি সংসদীয় আসন থেকে সবচেয়ে বেশি ৭০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। এই আসনের বাইরে আরও ১০০ সংসদীয় আসেনর সীমানা পুনর্বিন্যাস চেয়ে আবেদন করা হয়েছে ইসিতে। সীমানা পুনর্বিন্যাসে বিএনপির প্রভাবশালী অনেক নেতা, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি ও আমলারাও চাপ দিচ্ছেন ইসিকে। এগুলো নিষ্পত্তি করা নিয়ে হিমশিম অবস্থা ইসির। ফলে সীমানা বিন্যাস ইস্যুতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি।
রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে পরিকল্পিতভাবে ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। তৎকালীন নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের প্রেসক্রিপশনে একপেশে সিদ্ধান্ত নিয়ে ২৯৭ সংসদীয় আসনে সীমানা পুনর্বিন্যাস করে। জনগণের চাওয়া অনুযায়ী ২০০১ সালের সীমানায় নির্বাচন করতে চান তারা।
তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি বলেছেন, পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক তদবির আসবে। আমরা সবার কথাই শুনব। কিন্তু কেউ বিরাগভাজন হয়, এমন কোনো মন্তব্য করব না। কারো চাপের কাছে নতি স্বীকার করব না। সবার জন্য যেটা কল্যাণ হবে এবং আমাদের বিবেচনায় সঠিক মনে হবে, আমরা সেটাই করব। আমরা কারো পক্ষে-বিপক্ষে না, নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করব।
ইসির তথ্যমতে, তিন পাবর্ত্য অঞ্চল ও গোপালগঞ্জ জেলা বাদে ২৯৭ সংসদীয় আসনে ২০০৮ সালে ব্যাপক পরিবর্তন আনে ইসি। এর মধ্যে ১২৯ আসনে আমূল পরিবর্তন এনেছিল তৎকালীন কমিশন। এমনকি জেলার আসন কমিয়ে ঢাকায় ৮টি বাড়ানো হয়। পৃথক দুটি সংসদীয় আসনকে ভেঙে একটি আসনে রুপান্তরিত করা, উপজেলাকে দ্বিখণ্ডিত করে প্রশাসনিক ইউনিটকে তছনছ করে ফেলা হয় এবং একটি ইউনিয়নকে দুটি সংসদীয় আসনে ভাগ করার নজির তৈরি করা হয়। এসব নিয়ে ওই সময়ে সংক্ষুব্ধরা শত শত অভিযোগ দিলেও তা আমলে নেয়নি এক-এগারোর সেনা সমর্থিত ড. শামসুল হুদা কমিশন। এরপর গত তিনটি কমিশন সীমিত পরিসরে আসনবিন্যাস করে নির্বাচন সম্পন্ন করেন।
এদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পুনর্গঠিত কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো ঘোষণা ছাড়াই সীমানা পুনর্বিন্যাস দাবি করে আবেদনের হিড়িক পড়েছে। ইসির তথ্য বলছে, সংসদীয় ৩০০ আসনের বিপরীতে ৭৬টি আসন থেকেই প্রায় ৭০০ অভিযোগ জমা পড়েছে ইসিতে। ঢাকা-১ ও (দোহার-নবাবগঞ্জ) ও ঢাকা-২ (কেরানীগঞ্জ, লালবাগ), কুমিল্লা-১০ (সদর দক্ষিণ-লালমাই-নাঙ্গলকোট), বরগুনা-১ (সদর, আমতলী ও তালতলী) বরগুনা-২ (বামনা-পাথরঘাটা ও বেতাগী) এবং পিরোজপুর-২ (কাউখালী-ভান্ডারিয়া-নেছারাবাদ) আসন সর্বোচ্চ অভিযোগ এসেছে।
এই ৭৬ আসনের বাইরেও ১০০ আসনে পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য আবেদন জমা হয়েছে। এগুলো নিষ্পত্তি করা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ইসি। প্রতিদিনই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, সংশ্লিষ্ট আসনের সংক্ষুব্ধ নাগরিক, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি এবং সরকারের প্রভাবশালী আমলারা ইসিতে এসে কিংবা টেলিফোনে আসনটি বিন্যাস করার অনুরোধ জানাচ্ছেন। একইভাবে কেউ পুনর্বিন্যাসের জন্য বেশ জোরাজুরিও করছেন। আবার কেউ কেউ ২০০১ সালের পুরোনো সীমানা বহাল করার পক্ষে নানা যুক্তি দেখিয়ে কমিশনকে মোটিভেশন করার চেষ্টা করছেন।
ইসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য কমিশনারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুমিল্লার দাউদকান্দি আসনটি আগের অবস্থায় ফেরানোর জন্য দূতিয়ালি করে গেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে। একইভাবে ফরিদপুরের একটি আসনের জন্য তদবির করে গেছেন বিএনপির কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল। আর ফেনী জেলা বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা তার এলাকার বিদ্যমান আসনটির সপক্ষে নানা যুক্তি দেখিয়ে তদবির করে গেছেন।
কমিশন সূত্র জানায়য়, গত ১৭ জুন সিইসিসহ ৪ নির্বাচন কমিশনার এবং জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তবে সেখানে ইসির কর্মকর্তা কাউকে রাখা হয়নি। অনেকটা গোপনীয়তার স্বার্থে জিআইএস পদ্ধতিতে বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যা ও প্রশাসনিক অখণ্ডতার আলোকে সীমানাবিন্যাস করার জন্য সংশ্লিষ্ট অ্যাপে তথ্য সন্নিবেশ করেন। এর পরই মূল চ্যালেঞ্জ ও অসুবিধার ধরা পড়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে।
এর আগে আবেদনগুলোর যৌক্তিকতা বিবেচনায় সিরাজগঞ্জ, বরগুনা ও ঢাকা জেলায় নূন্যতম একটি করে আসন বাড়ানোর খসড়া চূড়ান্ত করেছিল। এর বিপরীতে রাজশাহী, গাজীপুর ও ঢাকা মহানগরীর একটি আসন কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল। একই সঙ্গে কিছু উপজেলার অখণ্ডতা দূর করে একক প্রশাসনিক ইউনিট করার উদ্যোগও ছিল ইসির। সব মিলিয়ে ২০টি সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস করার চিন্তা ছিল।
নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ বলেন, দু-তিনটি আসন বাড়ানো লাগতে পারে। তবে এটিও খসড়া, আরও পর্যালোচনা করতে হবে, তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তিনি বলেন, সর্বশেষ আদমশুমারির আলোকে সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন করা হলে নানা ধরনের আইনি মারপ্যাঁচে পড়তে পারে কমিশন। এ কারণে আরো যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইসি। বিদ্যমান আইনের বাইরে জিআইএস অ্যাপে এই প্রথম আসনওয়ারি বিদ্যমান ভোটার সংখ্যা দিয়ে ৩০০ সংসদীয় আসনের অবস্থান জানা ও বোঝার চেষ্টা করবে কমিশন। ২২ জুন থেকে এ পদ্ধতি নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করেছে কমিশন।
আরেক নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, আমরা ভোগোলিক অবস্থান, আয়তন ও জনসংখ্যা দিয়ে জিআইএস পদ্ধতি সংক্রান্ত অ্যাপ দিয়ে তথ্য যাচাই করেছি। এ পদ্ধতিতে কিছুটা অসংগতি মনে হয়েছে। তাই এবার আসনওয়ারি ভোটার সংখ্যা দিয়ে আরেকটি পর্যালোচনা করতে চাই।