সম্পাদকীয় : বিদেশে বাংলাদেশীদের অভিবাসন
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ জুন ২০২৫, ৯:২৭:০০ অপরাহ্ন
সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়ায় ‘রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ক্ষেত্রে রেকর্ড বাংলাদেশীদের’ শীর্ষক একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশে^র বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার হারে নতুন রেকর্ড করেছেন বাংলাদেশীরা। শুধু ২০২৪ সালেই ১ লাখ ৮ হাজার ১৩১ জন বাংলাদেশী বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন, যা এর আগের বছরের চেয়ে ৩২ হাজার ২৬৪ জন বেশী। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। তবে শুধু রাজনৈতিক আশ্রয় নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশে^র বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধনের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। শুধু ২০২৪ সালেই জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার কাছে ২৮ হাজার ৪৭৩ বাংলাদেশী শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে বলছেন, মূলত: উন্নত বিশে^ স্থায়ী হওয়ার আশায় বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী অবৈধভাবে পাড়ি জমাচ্ছেন ইউরোপ ও আমেরিকায় লাখ লাখ টাকা খরচ করে সেখানে গিয়ে স্থায়ী হওয়ার আশায়ই রাজনৈতিক আশ্রয় কিংবা শরণার্থী হিসেবে আবেদন করেন। এর ফলে প্রতি বছরই বাড়ছে বাংলাদেশীদের রাজনৈতিক আশ্রয় ও শরণার্থীর সংখ্যা। মূলতঃ অর্ধেক মাইগ্রেশনই এই হার বাড়ার পেছনে দায়ী।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশীদের বিদেশে অবৈধ মাইগ্রেশন বা অভিবাসন নতুন কোন বিষয় নয়। বিগত চল্লিশের দশক থেকে বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশীদের যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অন্যান্য কিছু দেশে প্রবাসী হওয়ার প্রবণতা লক্ষনীয়। ঐ সময় বেশীর ভাগ লোক বৈধ পন্থায় ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশে গেলেও অনেকে গেছেন অবৈধ পন্থায়। ফটো বদল করে কিংবা অন্যের পাসপোর্টে ব্রিটেন যাওয়া লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। প্রথম দিকে রাজনৈতিক আশ্রয় বা শরণার্থী হিসেবে আবেদনের বিষয়টি ছিলো না বললেই চলে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গোলযোগ হলে অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয় ও শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের আবেদন করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থায়ী হওয়ার প্রচেষ্টা থেকেই এটা করা হয়। এতে অনেকেই সফল হন। এভাবে তারা নিজের পরিবার ও স্বজনদের ঐসব দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি করেন। বিষয়টি ব্রিটেনসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সরকারগুলো জানতো না এমন নয়। তারা অবৈধ অভিবাসনকে কখনো কঠোরভাবে দেখেনি কিংবা নিরুৎসাহিত করেনি। বরং দেশে শ্রমিক সংকট ঘুচাতে অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ অভিবাসনকে প্রশ্রয় দিয়েছে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও আমেরিকার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কিন্তু সাম্প্রতিককালে অভিবাসনের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে এসব দেশ অভিবাসন আইনকে কঠোর করেছে। শুধু তাই নয়, কঠোর থেকে কঠোরতর করছে প্রতিনিয়ত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনী ইশতেহারে অবৈধ অভিবাসন বন্ধের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তাই ক্ষমতায় আসার পরই তিনি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে ওঠেছেন। এ নিয়ে সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে তুলকালাম কান্ড ঘটেছে। অপরদিকে যুক্তরাজ্য অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে একের পর এক আইন প্রণয়ন করে চলেছে। অবশ্য ইতালিসহ বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশ অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে এখনো নমনীয়। ফলে অনেক বাংলাদেশী পর্তুগাল ও ইতালিসহ বিভিন্ন স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশে আশ্রয়ের সন্ধানে হন্যে হয়ে ছুটছেন। ব্যর্থ হওয়ার সংখ্যা বেশী হলেও অনেকেই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ার ক্ষেত্রে সফল হচ্ছেন।
এখানেও বিপুল অর্থ ব্যয় ও ঝুঁকি জড়িত। যারা এই অর্থ ব্যয় করার ও ঝুঁকি নেয়ার সাহস করছেন, তারাই সফল হচ্ছেন। এক্ষেত্রে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নোয়াখালি অঞ্চল এগিয়ে আছে। এসব অঞ্চলের বৈধ ও অবৈধ অভিবাসীরাই প্রতি বছর বিপুল রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন দেশে। দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা রয়েছে বলতে গেলে টিকে আছে তাদের পাঠানো অর্থে। তাই বিষয়টিকে বাংলাদেশের সরকারী বা বেসরকারী কোন পর্যায় থেকেই অস্বীকার কিংবা অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। তবে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জিত হলে এতো বিপুল বাংলাদেশীকে অর্থ ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ অভিবাসী বা প্রবাসী হতে হতো না। এজন্য মূলত: দায়ী এদেশের অসৎ রাজনৈতিক কালচার বা সংস্কৃতি। সীমাহীন দুর্নীতি ও রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছার ঘাটতি থেকেই এদেশ অর্জন করতে পারেনি কাক্সিক্ষত সমৃদ্ধি। আর এ অবস্থার চরম বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় বিগত ১৫/১৬ বছরে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে, যা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়।