সম্পাদকীয় : নিয়ন্ত্রণহীন সড়ক, দেখবে কে?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুলাই ২০২৫, ৮:১৩:৫১ অপরাহ্ন
সম্প্রতি মিডিয়ায় ‘নিয়ন্ত্রণহীন সড়ক, বেড়েছে প্রাণহানি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত জুন মাসে দেশে ৬৮৯ সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন ৬৯৬ জন ও আহত হয়েছেন ১ হাজার ২৬৭ জন। এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ প্রাণ হারিয়েছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। একটি দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় এতো বিপুল প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনা খুব কমই পরিলক্ষিত হয় বিশে^। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে জাতীয় মিডিয়া ‘বণিকবার্তা’ সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশী মৃত্যু’ শিরোনামে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে এই ইস্যু নিয়ে মূল্যায়ন ও মূল্যবান পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশে এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশী প্রাণহানি হয়েছে ২০২৪ সালে। এ সময় মারা গেছেন ৫ হাজার ৩৮০ জন। এটা সরকারী হিসাব। তবে বেসরকারী দু’টি সংস্থা এই সংখ্যা ৭ থেকে সাড়ে ৮ হাজার বলে উল্লেখ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়কে প্রাণহানির ঘটনা ক্রমেই বেড়েই চললেও তা প্রতিরোধে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গণঅভ্যুত্থানে বিগত সরকারের পতনের পর সড়কে প্রাণহানি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এখন পর্যন্ত সড়ক ও মহাসড়কে শৃংখলা ফেরাতে কার্যকর ও দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে রাজধানীসহ সারা দেশে সংঘটিত হয়েছিলো তুমুল ছাত্র আন্দোলন। এরপরই দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও সড়ক নিরাপদ করার লক্ষ্যে তৎকালীন সরকার আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা করে। যদিও পরবর্তী সময়ে আইন প্রয়োগে দুর্বলতা আর তার গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারায় সড়কে শৃংখলা ফেরেনি। বরং গত ৫ বছরের মধ্যে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে প্রাণহানি হয়েছে ২০২৪ সালে। কিন্তু চব্বিশের আন্দোলনের ফলস্বরূপ অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলে জনমানুষের অন্যতম প্রত্যাশা ছিলো, শৃংখলা ফিরে নিরাপদ হবে সড়ক, কমে আসবে প্রাণহানি। সড়ককে ঘিরে অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত যেসব কাজ বাস্তবায়ন করেছে তা অনেকটাই বিগত সরকারের কাজেরই ধারাবাহিকতা। সড়কে যানবাহনের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নীতিমালা করা হয়েছিলো। এখন পর্যন্ত সেটি কার্যকর করতে পারেনি বর্তমান সরকার। অথচ যানবাহনের অতিরিক্ত গতিকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে অভিহিত করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
দেখা গেছে, দশ-বিশ মিনিট আগে যাওয়ার জন্য অনেক যানবাহন চালক বিশেষভাবে বাসের চালক অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালিয়ে বিপজ্জনকভাবে ওভারটেইকের ঝুঁকি নেয়। ফলে প্রায়ই এসব যানবাহন দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এতে এসব যানবাহনের যাত্রীরা যেমন হতাহত হয় তেমনি অন্যান্য যানবাহনের যাত্রী এমনকি পথচারীরাও প্রাণ হারায়, আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে। প্রথমোক্ত প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে। শুধু গত মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মানব সম্পদের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এ এক ভয়ংকর বাস্তবতা।
প্রশ্ন জাগে, বিগত দেড় দশকে এদেশে বহু মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু হাজারো লেখালেখি ও দাবি জানানো সত্বেও তৎকালীন সরকার দেশে সুষ্ঠু সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাসহ ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে সড়কে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কোন প্রকল্প গ্রহণ করেনি। এ এক চরম দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। প্রতি বছর সড়কে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি সত্বেও টনক নড়েনি বিগত কিংবা আগের সরকারগুলোর। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এ পর্যন্ত এ নিয়ে নীরব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ তথা সরকারের শীর্ষ মহলের এ ধরনের অনীহা, উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতা দেশ ও জনগণের কতোটা ক্ষতি করছে, তা এখনি ভেবে দেখা ও সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। আর বিলম্ব না করে এ কাজটি করা অত্যন্ত জরুরী ও জনগুরুত্বপূর্ণ।