শহীদ তুরাব: এক দুরন্ত শ্বেত কপোত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০২৫, ৩:৩৯:৫৪ অপরাহ্ন
মুনশী ইকবাল:
তুরাব খুবই দুরন্ত ছিল। অনেক মজা করতো। বিয়ানীবাজারে মফস্বল সাংবাদিকতা থেকে ২০১৭ সালের দিকে দৈনিক জালালাবাদে যোগ দিয়ে শুরুতে ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতো। তখন আমার সাথে অনেক অ্যাসাইনমেন্টে সে তার ক্যামেরা নিয়ে সঙ্গী হয়। সেই দিনগুলো আজ মনে পড়ছে। তার অনেক ছবির ক্যাপশন এবং ছবির কাজ সে আমাকে দিয়ে করিয়ে নিতো। তারপর সে ধীরে ধীরে নিজেকে আরও মেলে ধরতে শুরু করে। সময়ের ব্যবধানে সে একটি জাতীয় দৈনিকের ব্যুারো সামলানোর দায়িত্ব পালন করে যেতে সক্ষম হয়।
মৃত্যুর আগের দিকে এসে তার আগেকার অনেক অভ্যাস ও স্বভাবের মধ্যে পরিবর্তন চলে আসে। একসময়ের উড়নচণ্ডী তুরাব অনেক স্থির ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। তার স্বভাবে একটা দৃঢ়তা ফুটে ওঠে। এতকিছুর পরও তুরাবের মধ্যে একটা শিশুসুলভ স্বভাব থেকে যেত। সে সব সময় একটা একসাইটেডের মধ্যে থাকতো। কোনো কাজ সফলভাবে করতে পারলে বা কোনো দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরলে শিশুদের মতো উচ্ছ্বসিত হতো।
সর্বশেষ মৃত্যুর আগেরদিন কোটা আন্দোলন চলাকালে শাহজালাল বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় পুলিশের ছিটাগুলি একটি স্প্রিন্টার তা গাঁ ছুয়ে চলে যায়। সন্ধ্যায় অফিসের সোফায় বসে সে আমাকে সেই কথা জানায় এবং বিপদ থেকে যে বেঁচে গেছে এজন্য খুব উচ্চসিত ছিল। এই সোফায় বসেই তুরাব তার অনেক না বলা কথা আমার সাথে শেয়ার করতো। যে কথাগুলো পেশাদার সাংবাদিকতা বা পত্রিকার জীবনে নতুনদের জন্য অনেকটা অবধারিত হয়ে গেছে।
রাতে অফিস থেকে বের হওয়ার সময় তাকে তার ডেস্কে কাজ করা অবস্থায় রেখেই আমি বেরিয়ে যাই। কে জানতো এটাই তার সাথে শেষ দেখা। পরদিন শুক্রবার দুপুরের দিকে সিনিয়র সহকর্মী নিজাম উদ্দীন সালেহ ভাই ফোনে জানান তুরাব পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে ওসমানী হাসপাতালে।
কিন্তু সেখানে কর্তব্যরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হওয়ায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সোবহানীঘাট ইবনে সিনা হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অত্যাধিক গুলির কারণে ডাক্তাররা তাকে বাঁচাতে পারেন নাই। এমতাবস্থায় চিকিৎসারত অবস্থায় ঐদিন সন্ধা ৬টা ৪৪ মিনিটের সময় সে শাহাদাত বরণ করে।
সিলেটের যেসব সংবাদকর্মীর পুলিশের সাথে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ ও সখ্যতা, তুরাব তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সেই সূত্রে সে পুলিশের পরিচিত থাকাই স্বাভাবিক। ফলে যেকোনো পরিস্থিতিতে সবার আগে পুলিশের তাকে চেনার কথা।
তুরাব নিহতের ঘটনায় যে পুলিশ কর্মকর্তা সাদেক কাওসার দস্তগীরের নাম শোনা যায় সেই দস্তগীরেরও সে পরিচিত। দস্তগীর এর আগে যখন এসএমপির কোতোয়ালি থাকার সহকারী কমিশনার তখন থেকে তার সাথে তুরাবের সখ্যতার কথা আমি তুরাবের মুখেই শুনেছি।
তুরাব ছিল পুলিশ বান্ধব একজন সংবাদ কর্মী। একবার একটি হত্যা মামলার তদন্তকালে এক সহকারী কমিশনার পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তার সাথে আমার বাকবিতন্ডা হয়। সেই কর্মকর্তার রহস্যময় আচরণ আমাকে বিস্মিত করে। অফিসে এসে এটা আমি ওর সাথে শেয়ার করি কারণ এই কর্মকর্তার সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। বলি যে বিষয়টি আমি শক্তভাবে দেখবো, তোমার সম্পর্ক তাই তোমাকে জানালাম। তখন তুরাব আমার থেকে সময় নেয় এবং জানায় ঐ কর্মকর্তা তার ভুল স্বীকার করেছেন। সেসময় ঐ কর্মকর্তার রুমে যুক্তরাজ্য প্রবাসী এক আওয়ামীলীগ নেতা পরবর্তীতে যিনি জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন তার এক চামুণ্ডা উপস্থিত ছিলেন। ঐ লোক সকাল থেকে নাকি নানান তদবিরে সেই অফিসারের মেজাজ নষ্ট করে দিয়েছিল। আমার যেহেতু নিয়মিত থানায় যাইনা তাই সেই অফিসার বিষয়টি বুঝতে পারেন নি।
তুরাব সবসময় মাঠে ময়দানে বিচরণ করে বেড়াতো বিধায় নানান ধাচের পুলিশের সাথে তার পরিচয় ছিল। ফলে যেকোনো পরিস্থিতিতে তাকে সবার আগে পুলিশের চেনার কথা। কিন্তু তুরাবের ঘনিষ্টজন পুলিশের গুলিতেই একেবারে কাছ থেকে তুরাব আহত হওয়ার খবর আসলেই অপ্রত্যাশিত এবং দুঃখজনক।