মুখ থুবড়ে পড়েছে কলকাতার পূজার বাজার : নেই বাংলাদেশি ক্রেতা
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৮:৩২:০১ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক : এক সময় পূজার আগে কলকাতার বাজার মানেই হাঁটার জায়গাও নেই। গড়িয়াহাট থেকে হাতিবাগান, নিউমার্কেট থেকে শ্যামবাজার-সব জায়গা থাকত চিলেকোঠা অবধি ভরা। সেই পরিচিত ছবি এ বছর যেন উধাও। বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেনাকাটার দিন, পূজার আগের শেষ মুহূর্তেও কার্যত খাঁ খাঁ করছে কলকাতার দোকানপাট।
করোনাপরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার চেষ্টা থাকলেও এ বছর বড় ধাক্কা খেলেন ব্যবসায়ীরা। তাদের ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ার অন্যতম কারণ বাংলাদেশের ক্রেতাদের অনুপস্থিতি। সঙ্গে আন্দোলন, টানা বৃষ্টি এবং জলাবদ্ধতার মতো কারণও যুক্ত হয়েছে।
কলকাতার উৎসব বাণিজ্যে বাংলাদেশের পর্যটক ও ক্রেতারা দীর্ঘদিন ধরেই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। প্রতি বছর পূজার আগের এই সময়টায় হাজার হাজার মানুষ ভিসা নিয়ে কলকাতায় যেতেন কেনাকাটা করতে। বিশেষ করে জামা-কাপড়, শাড়ি, জুয়েলারি, প্রসাধনী, ব্যাগ, জুতা, কসমেটিকস- এসব পণ্য প্রচুর বিক্রি হতো। কিন্তু এবার সীমান্তে কড়াকড়ি, ভিসা সমস্যাসহ নানা কারণে তাদের অনেকেই কলকাতায় যেতে পারেননি। ফলে এখানকার বহু ব্যবসায়ী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
হাতিবাগান মার্কেটের দোকানদার বলেন, ‘সকাল আটটা থেকে দোকান খুলেছি, এখনো পর্যন্ত একজন ক্রেতাও আসেননি। প্রতি বছর এই সময় বাংলাদেশ থেকে বহু পরিবার আসত। তারা একসঙ্গে পাঁচ-দশটা জামা কাপড় কিনত। এবার একজনকেও দেখলাম না।’
একই কথা শোনা গেল গড়িয়াহাটের ব্যাগ বিক্রেতা অভিজিৎ দত্তের মুখেও। তিনি বলেন, ‘আগের বছর এই সময় বিক্রি করতে করতে সময় পেতাম না, এবছর সকাল থেকে এক টাকাও বিক্রি হয়নি।’
শুধু পোশাক নয়, অলঙ্কার ব্যবসায়ও একই চিত্র। জানা গেছে, আগের বছর খানিকটা বিক্রি হয়েছিল, এবারে সেটাও নেই।
গড়িয়াহাটের জামাকাপড় বিক্রেতা সমর ঘোষ বলেন, ‘বাংলাদেশিরা আসতেন বলেই এত মাল আনতাম। এবার সব গুদামেই পড়ে থাকবে মনে হচ্ছে। ট্রেন চলছে না, সীমান্ত দিয়ে অনেকেই ঢুকতে পারছেন না। ভিসা পেতে সমস্যা হচ্ছে বলেও শুনছি। তাই তারা আসেনি। আর তারা না এলে এই বাজার আর চলে না।’
বাংলাদেশি ক্রেতাদের অনুপস্থিতির সঙ্গে যোগ হয়েছে শহরের সাম্প্রতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতি। শহরের রাজনীতিক কারণে বিভিন্ন অঞ্চলজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। পথে নেমেছেন হাজার হাজার মানুষ। রাজপথ কাঁপছে আন্দোলনে।
বাজারে এসেছেন যারা, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বলছেন প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে এসেছেন, পূজার কেনাকাটা করতে নয়। কেউ কেউ বলছেন, পূজায় বেরোনোরই ইচ্ছে নেই, তাই কেনাকাটার প্রয়োজনও নেই। অনেক ক্রেতা আবার বলছেন, প্রতিবাদের পক্ষে থাকলেও তারা মনে করেন ব্যবসায়ীদেরও বাঁচতে হবে। আন্দোলনের মধ্যে ব্যবসার দিকে যেন একটু তাকানো হয়।
বৃষ্টিও যেন সঙ্গী হয়েছে এই বিপর্যয়ের। টানা কয়েক দিন ধরে নিম্নচাপের কারণে শহরের একাধিক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ছাতা মাথায় বাজারে আসতে চায় না সাধারণ মানুষ। ফলে ক্রেতা নেই, বিক্রিবাটা নেই, উৎসবের আগে রীতিমতো চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
নিউমার্কেট থেকে গড়িয়াহাট, হাতিবাগান থেকে হাওড়া—সব জায়গাতেই দোকানদারদের মুখে একই হতাশা। কেউ বলছেন, গত বছর এই সময় দিনে ৩০ হাজার টাকার ব্যবসা হতো, এবারে ১০ হাজারও ছুঁইছে না। কেউ বলছেন, যেটুকু স্টক তোলা হয়েছে, সেটা বিক্রি না হলে চড়া সুদের বাজারি ঋণ শোধ করার উপায় থাকবে না। ব্যাংকের ঋণ তো মেলে না, ফলে অনেকেই স্থানীয় মহাজন বা এনজিও থেকে টাকা তুলে স্টক এনেছেন। এখন সেই টাকা তুলে আনা নিয়েই তৈরি হয়েছে গভীর চিন্তা।
ফুটপাথের অনেক বিক্রেতাই বলছেন, যারা এসেছেন তারা শুধু দেখছেন, কিনছেন না। বাংলাদেশি ক্রেতারা যেভাবে একবারে দশ-পনেরো পিস মাল কিনতেন, সেই ধরনের ক্রেতা নেই বললেই চলে।
কলকাতার পূজার বাজারে এ বছর যে মন্দা দেখা দিয়েছে, তা বাংলাদেশের ক্রেতারাও স্বীকার করছেন। নিয়মিত যারা প্রতি বছর পরিবার নিয়ে কলকাতায় কেনাকাটা করতে যেতেন, তাদের কথায় ধরা পড়ছে হতাশার সুর। অনেকেই জানিয়েছেন, সীমান্তে কড়াকড়ি, ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকা, ভিসা জটিলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবার কলকাতায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে তারা নিজেরাও বঞ্চিত হয়েছেন উৎসবের আগে পছন্দের পোশাক, শাড়ি, অলঙ্কার বা প্রসাধনী কেনার আনন্দ থেকে।
বাংলাদেশি ক্রেতাদের মতে, কলকাতার বাজারে তাদের অবদান অনেক বড়। একবার গেলে তারা একসঙ্গে একাধিক জামা-কাপড়, শাড়ি বা ব্যাগ কিনতেন। এতে শুধু ব্যবসায়ীরাই লাভবান হতেন না, বরং কলকাতায় অবস্থানকালে হোটেল-রেস্তোরাঁ, পরিবহন, বিনোদন সব খাতে অর্থ খরচ হতো। ফলে দুই বাংলার মানুষের মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক যোগসূত্র তৈরি হতো। এবার সেই ধারাবাহিকতা ভেঙে যাওয়ায় তারা নিজেরাও কষ্ট পাচ্ছেন।
তাদের অভিমত, কলকাতার ব্যবসায়ীরা যেমন সমস্যায় পড়েছেন, তেমনি বাংলাদেশের মানুষও এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করছেন। কেনাকাটার পাশাপাশি পূজার আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় অনেকে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলেছেন, সীমান্ত সমস্যার দ্রুত সমাধান দরকার। ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হলে এবং যাতায়াত স্বাভাবিক থাকলে তারা আগের মতো আবার কলকাতায় যাবেন। বাংলাদেশি ক্রেতাদের আশা, আগামী বছর আবার তারা ভিড় জমাবেন কলকাতার বাজারে, আর সেই ব্যস্ততা ফিরবে ব্যবসায়ীদের মুখেও।
বিভিন্ন ব্যবসায়িক সমিতির পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, এবারের পূজায় ব্যবসা গত বছরের চেয়ে কমপক্ষে ৪০-৫০ শতাংশ কম হবে। বাংলাদেশের পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল এই বাজারে তাদের অনুপস্থিতি বড় ক্ষতি করে দিয়েছে। অনেকে বলছেন, কোভিডের পরেও যতটা ব্যবসা হয়েছিল, এবারে তা-ও হচ্ছে না।
মার খাচ্ছেন শুধু দোকানদার নন, হকার থেকে শুরু করে হোটেল, রেস্তোরাঁ, অটোচালক, ট্যাক্সিওয়ালা—সবাই। বাংলাদেশ থেকে আসা পর্যটকেরা অনেকটা সময় কাটান শহরের বিভিন্ন জায়গায়। শুধু শপিং নয়, খাবার, যাতায়াত, বিনোদন—সব ক্ষেত্রেই তাদের খরচ শহরের ক্ষুদ্র অর্থনীতিকে চাঙা করে। এবার সেই অর্থও আসেনি।
শেষ ভরসা এখন পূজার আগের দুই দিন। মহাষষ্ঠী আর মহাসপ্তমীতে শহরের মানুষজন একটু বেরিয়ে কেনাকাটা করলে হয়ত কিছুটা ঘাটতি মেটানো যাবে। কিন্তু বাংলাদেশি ক্রেতারা না ফিরলে ভবিষ্যতে এই ব্যবসা কতটা টিকবে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন বহু ব্যবসায়ী।